এক ফোঁটা চোখের জলঃ লিটন হোসাইন জিহাদ

লেখক: লিটন হোসাইন জিহাদ
প্রকাশ: ১ মাস আগে

বর্ষার এক স্নিগ্ধ বিকেল। আকাশে ধূসর মেঘের ছায়া, মাঝেমাঝে এক পশলা বৃষ্টি এসে ছুঁয়ে দিয়ে যায় প্রকৃতিকে। শহরের কোলঘেঁষে নির্মিত একটি কৃত্রিম লেক—নিভৃত, শান্ত, যেন একান্ত ভাবনার মতো নীরব। লেকের পাড়ে সারি সারি কৃষ্ণচূড়া গাছ, লাল রঙে ঢেকে দিয়েছে মাটিকে—যেন কারও ফেলে যাওয়া প্রেমপত্রের ছিন্নচূর্ণ পাতা। বাতাসে ভাসে বেলি, জুঁই আর কদম ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ।

লেকপাড়ের একটি কাঠের বেঞ্চে বসে আছে তোফা। চুপচাপ, নিঃশব্দ। তার চোখের গভীরে ঝরে পড়ছে কিছু অদৃশ্য জিজ্ঞাসা, হৃদয়ে কেবল নিরবতা। তার পাশে বসে আছেন একজন বৃদ্ধ—দাদাভাই। সাদা পাঞ্জাবিতে তাঁর শরীর সিক্ত, কিন্তু মুখে আছে এক অপার্থিব প্রশান্তি, যেন বহু দূর পেরিয়ে আসা একজন যাত্রী, যিনি সব হারিয়ে সবকিছু পেয়েছেন।

হঠাৎ তোফা মুখ তোলে, চোখে এক প্রশ্নের রেশ:
— দাদাভাই, আপনি তো বলেছিলেন—প্রেমই নাকি জীবন। অথচ আমি তো দেখছি, প্রেমহীন জীবনও বয়ে চলে। আমি হাঁটি, খাই, ঘুমাই… তারপর আবার সকাল… তবুও তো বেঁচে আছি। তাহলে প্রেম কি শুধুই কাব্যিক এক অলীকতা?

দাদাভাই হালকা হেসে বলেন:
— তোফা, বেঁচে থাকাকে যদি তুমি শুধুই দেহের শ্বাসপ্রশ্বাস বলো, তাহলে হ্যাঁ, প্রেম ছাড়াও মানুষ বাঁচে। কিন্তু জীবন কি কেবল দেহের অস্তিত্ব? জীবন মানে আত্মার সজাগতা। প্রেম সেই আত্মার ভাষা। আত্মা যদি জল হয়, প্রেম তার ঢেউ। আর ঢেউহীন জলে কোনো নৌকা ভেসে চলে না—সে কেবল স্থির হয়ে থাকে, প্রাণহীন।
তোফা গম্ভীর হয়ে যায়। একটু নড়েচড়ে বসে। দূরের লেকের জলে নুয়ে পড়া পদ্মপাতার দিকে তাকিয়ে থাকে। তোফা কাঁপা কণ্ঠে বলে:
— কিন্তু প্রেম তো কেবল আঘাত দিয়ে গেছে। যে কাছে এসেছে, সে তৃষ্ণা বাড়িয়ে গেছে। যে ভালোবাসি বলেছে সেই ছুরি মেরেছে পিঠে। আমি যে খালি হাতে দাঁড়িয়ে আছি—এই না পাওয়ার, এই বিরহেরই বা মানে কী?

দাদাভাই এবার একটু চুপ করে থাকেন। তারপর ধীরে বলেন—  না পাওয়াই তো সবচেয়ে গভীর পাওয়া, তোফা। প্রেম কখনও পূর্ণতা দিয়ে আসে না, সে আসে অসমাপ্তির ছায়া হয়ে—যাতে তোমার ভেতরে খোঁজটা জাগে। হৃদয় যখন ভেঙে যায়, তখন সেখানে ঈশ্বরের আসন তৈরি হয়। সেই ফাঁকা জায়গাতেই বসে থাকে নিরব এক পরম।

তোফা প্রশ্ন করে:
— তাহলে কি বিরহই ঈশ্বরীয়? ভালোবাসা মানেই কি না-পাওয়া?

দাদাভাই মাথা নেড়ে বলেন:
— ভালোবাসা মানে আত্মা থেকে আত্মার দিকে যাত্রা। মানুষ যদি প্রেমে পূর্ণ হতো, তবে সে ঈশ্বরকে খুঁজতো না। প্রেম আমাদের অপূর্ণ রাখে, যেন আমরা খুঁজি—জিজ্ঞাসা করি। বিরহ তাই প্রার্থনা হয়ে ওঠে। রুমি বলেছিলেন না—”Your task is not to seek for love, but to find all the barriers within yourself that you have built against it.” তোমার কান্নাই তোমাকে প্রেমিক করে তোলে।

তোফার চোখে জল জমে ওঠে। — আমি মাঝেমধ্যে ভাবি, আমি হয়তো প্রেমের যোগ্যই নই। যাকে চেয়েছি, সে ফিরেও তাকায়নি।

দাদাভাই মৃদু স্বরে বলেন:
— তুমি যে ভালোবেসেছো—এটাই তোমার কাছে ঈশ্বরের দান। যে তাকায়নি, সে ছিল তোমার জন্য একটি আয়না। তুমি তার চোখে নিজের হৃদয়কেই দেখেছো। তোমার ভালোবাসা ছিল তোমার আত্মার প্রতিচ্ছবি।

তোফা এবার ফিসফিস করে:
— তাহলে কী আমি এই একাকীত্ব নিয়েই বাঁচব? এই প্রেমহীন পৃথিবীতে আত্মার আগুন নিভিয়ে?

দাদাভাই দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলেন:
— একাকীত্ব মানে প্রেমহীনতা নয়, বরং গভীর আত্মবিশ্লেষণ। একাকীত্বে তুমি নিজেকেই খুঁজে পাও। প্রেম মানে শুধু অন্য কারো হাত ধরা নয়—প্রেম মানে নিজের ভেতরের ঈশ্বরের স্পর্শ খোঁজা। প্রেমহীন জীবন নেই, কারণ প্রেম নিজেই জীবন।

তোফা চুপচাপ চাঁদের দিকে তাকায়। জিজ্ঞাসা করে:
— তাহলে দাদাভাই, এই জীবনটা কী? যে জীবনে হারিয়ে যাওয়াই নাকি চরম খোঁজ?

দাদাভাই চোখ বন্ধ করে বলেন:
— জীবন মানে এক মহাযাত্রা। প্রেম থেকে বিরহ, বিরহ থেকে জিজ্ঞাসা, আর সেই জিজ্ঞাসা থেকেই জন্ম হয় চেতনার। এই চেতনাই শেষ পর্যন্ত নিয়ে যায় আত্মার সেই দিগন্তে, যেখানে প্রেম আর ঈশ্বর একই নদীর দুই কূলে দাঁড়িয়ে হাসেন।

বিজলি চমকে ওঠে দূরে। কৃষ্ণচূড়ার পাতার ফাঁকে একটু রোদ এসে পড়ে তোফার মুখে। বৃষ্টি থেমে যায়। চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে এক অদৃশ্য আত্মিক সঙ্গ। যেন লেকের জল, ফুলের ঘ্রাণ আর দুটো আত্মার মধ্যকার সংলাপ মিলে সৃষ্টি করছে এক মহাপার্বণ।

তোফা ধীরে বলে:
— তবে তো প্রেম হারালে নয়, প্রেম খুঁজলে জীবন অর্থ পায়।

দাদাভাই মাথা নেড়ে বলেন:
— ঠিক তাই, তোফা। জীবন মানেই প্রেমের বেদনায় পরিপূর্ণ থাকা—এটাই আত্মার সবচেয়ে বড় অর্জন।

তারা বসে থাকেন নিঃশব্দে। নিস্তব্ধ লেকের জলে প্রতিফলিত হয় কৃষ্ণচূড়ার ডালপালা, তাদের কথা, আর এক গভীর উপলব্ধি—প্রেম মানে শুধু পাওয়া নয়, বরং নিজেকে খুঁজে পাওয়া

পর্ব ২

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা আসে। আলো আর অন্ধকারের মাঝখানে যে নীরবতা জমে, সেইখানে বসে থাকে তোফা। তার সামনে সেই একই লেক, তবে এবার চারপাশে নিঃস্তব্ধতা ঘনীভূত। দাদাভাই চলে গেছেন। তোফা একা। অথচ এই একাকীত্বের গভীরে আজ এক আশ্চর্য আলো অনুভব করে সে।

হাতের মুঠোয় ধরা ডায়েরিটা খুলে বসে সে। পুরোনো, জীর্ণ পৃষ্ঠায় লেখা কয়েকটি লাইন চোখে পড়ে—

“তোমার চোখে আমার জন্য যেটুকু অভিমান জমে ছিল,
আমি চেয়েছিলাম তা দিয়ে এক ছায়া বানাতে—
যেখানে দাঁড়িয়ে আমি নিজেকে দেখতে পারি।
তুমি তা বুঝোনি।
আমি বলেও পারিনি।
তুমি চলে গেলে—তবু আমি থেকে গেলাম,
তোমার সেই না বলা কথাগুলোর ভেতরে।”

তোফা ডায়েরির পাতায় আঙুল বোলায়, যেন শব্দগুলো ছুঁয়ে কোনো পুরোনো ঘ্রাণ খোঁজে। এক নামহীন ভালোবাসার মানুষ ছিল তার জীবনে—যার ছায়া সে কোনোদিন ভোলেনি।

নাম তার শারদিনী। খুব সাধারণ এক মেয়ে—কিন্তু তার হাসি ছিল অসাধারণ। তোফার জীবনের প্রথম প্রেম। তারা কখনো ‘প্রেমে পড়েছি’ বলেনি। তবুও প্রতিটি দুপুরে ভেজা চুলের ঘ্রাণে, প্রতিটি সন্ধ্যায় বৃষ্টির শব্দে, প্রতিটি রাতের জোনাকির আলোয় তারা ভালোবেসে গেছে।

একদিন শারদিনী হঠাৎ করেই দূরে সরে যায়। কারণ সে জানত—তোফার জীবন তার চেয়েও বড় কিছু। শারদিনী চেয়েছিল তোফা কবি হোক, আকাশ ছোঁক। সে নিজে যেন হয়ে উঠেছিল এক চুপচাপ সিঁড়ি—যে সিঁড়ির কথা কেউ মনে রাখে না, কেবল ব্যবহার করে ওপরে ওঠে।

তোফা জানত না, কেন সে চলে গেল। কেবল একটা চিরকুট পেয়েছিল—

“তুমি আরও গভীর, আরও বিশাল কিছু খোঁজো… আমি কেবল একটি নদী, তোমার সমুদ্র হওয়ার পথে…”

তোফা সেদিন কাঁদেনি। কিন্তু প্রতিদিন কাঁদতো শব্দের ভেতরে। সে কবিতা লিখতো, গল্প লিখতো, রাত জেগে ভাবতো—শারদিনী কি আজও একই আকাশের নিচে আছে? কেউ তাকে নিয়ে কবিতা লেখে কি?

এভাবে কেটে গেছে বছর। তোফা এখন লেখক, খ্যাতিমান, শহরে বাস করে—তবু ভেতরে এক পাহাড়ি ঝরনার মতো এক অস্থিরতা, যে কোথাও থামে না। যে প্রেম তাকে পূর্ণ করেনি, সেই প্রেমই তাকে পরিপূর্ণ বানিয়েছে।

আজ সে দাদাভাইয়ের কথা ভাবছে।

“জীবন মানে এক মহাযাত্রা—প্রেম থেকে বিরহ, বিরহ থেকে জিজ্ঞাসা, আর জিজ্ঞাসা থেকে চেতনা।”

হ্যাঁ। সে বুঝতে শুরু করেছে, শারদিনী চলে যাওয়াটা কোনো ভুল ছিল না। বরং সেটাই ছিল এক আলো, যে আলো তার হৃদয়কে জ্বালিয়ে আজ এতো কবিতা লিখিয়েছে, এতো মানুষের মনে পৌঁছে দিয়েছে তার কথা।

হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে। নাম্বারটা অপরিচিত, কিন্তু ভয়ানক পরিচিত মনে হয়।

— “হ্যালো?”

ওপাশ থেকে নরম গলা—একটা মেয়ের।

— “তোফা… আমি শারদিনী। এতো বছর পর বিরক্ত করলাম না তো?”

তোফার বুকের মধ্যে কেমন যেন একটা ভাঙা কাঁচের শব্দ বাজে। সে চুপ করে থাকে।

— “তুমি লিখেছিলে… ‘আমি এখনও সেই নদীর অপেক্ষায় আছি, যে আমাকে একবার ভিজিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছিল’। আমি সেই নদী, তোফা। আমি এখনও বইছি—তুমি কি থেমে আছো?”

তোফার চোখে জল আসে। সে কেবল বললো—

— “আমি এখনও সেদিনের লেকের পাশে বসে আছি, শারদিনী। তুমি একবার ফিরে এসো, তারপর চলে যেও। আমি আবার তোমার চলে যাওয়ার পেছনে দাঁড়িয়ে দেখবো—কতটা ভালোবাসা দিয়ে কেউ কাউকে ছেড়ে যেতে পারে…”

ফোনটা নিঃশব্দ হয়ে যায়।

তোফা ডায়েরির পাতায় লেখে—

“তোমার না বলা কথাগুলোই আমার সবচেয়ে প্রিয় চিঠি।
আমি এখন বোঝি—ভালোবাসা মানেই ফিরে আসা নয়।
বরং, এক আত্মিক চুম্বকতা—যা চিরকাল টেনে রাখে,
এমনকি হারিয়ে যাওয়ার পরেও।

পর্ব ৩

শারদিনীর ফোন কেটে যাওয়ার পর, চারদিকটা হঠাৎ নিস্তব্ধ হয়ে যায়।
জীবনের মতোই—যেখানে কিছু কিছু উত্তর আর কখনও ফিরে আসে না,
শুধু থেকে যায় একটা অনুচ্চারিত কম্পন।
তোফা অনেকক্ষণ বসে থাকে লেকের পাশে। পাখিরা উড়ে যায়, নৌকাগুলো ঘাটে ফিরে আসে।
সূর্য ডুবে গেছে, আকাশে চাঁদ উঠেছে—কিন্তু তার চেহারা খুব নিঃসঙ্গ মনে হয়।

তোফা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়।
ডায়েরিটা সে বুকের কাছে চেপে ধরে।
হেঁটে হেঁটে চলে আসে এক পুরোনো গলি পথে—যেখানে শারদিনী একদিন হেসে বলেছিল,
“এই গলির শেষ মাথায় তুমি একদিন দাঁড়িয়ে থাকবে, আমি তখন অনেক দূরে থাকব। কিন্তু বাতাসে আমি থাকব, তোফা। ঠিক আমার মতো—অদৃশ্য, অথচ ছুঁয়ে যাওয়া যায়…”

সেই গলির মাথায় দাঁড়িয়ে তোফা হঠাৎ চোখ বন্ধ করে।
হাওয়াটা আস্তে আস্তে বইছে, যেন এক চিরন্তন আত্মা তার গাল ছুঁয়ে যায়।
সে জানে—শারদিনী ফিরে আসবে না।
কিন্তু আজকের এই সন্ধ্যায় সে বুঝে গেছে—ভালোবাসা মানে কারও ফিরে আসা নয়,
ভালোবাসা মানে: কারও ভেতর চিরকাল বেঁচে থাকা।

তোফা তার ডায়েরির শেষ পাতায় লিখে:

“তোমাকে আমি ক্ষমা করে দিইনি, শারদিনী—
আমি তো তোমাকে কোনোদিন দোষ দিইনি।
তুমি চলে গিয়েছিলে ঠিকই,
কিন্তু সেই না-ফেরার মাঝেও তুমি আমার ভেতরে গুঞ্জরিত থেকেছ।

আমি আর কাউকে ভালোবাসিনি—
আমি কেবল সেই অনুভূতিকে বাঁচিয়ে রেখেছি,
যেটা একদিন তোমার চোখে ছিল।

তুমি যদি শুনতে পাও…
তবে জেনে রেখো—
তোমার না বলা কথাগুলোই
আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় কবিতা।”

সেই রাতে, তোফা আর কিছু লেখে না।
সে শুধু জানালার পাশে বসে, আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
চাঁদটা যেন আজ শারদিনীর মুখ হয়ে উঠেছে।
ভেতরে ভেতরে, সে এক অশ্রুভেজা হাসি হাসে।

পরদিন সকালে শহরের এক কবিতার দোকানের দেয়ালে এই লাইন ঝুলতে দেখা যায়—

“সে কখনও ফেরেনি,
কিন্তু তার জন্য আমি আমার সমস্ত জীবন অপেক্ষা করেছি—
যেন ভালোবাসা এক সন্ন্যাস,
আর স্মৃতি তার মন্দির।”