তবে দীর্ঘ বারো বছর পর ভারতের কোনও প্রধানমন্ত্রী ওই সপ্তাহেই দ্বিপাক্ষিক সফরে বাংলাদেশ যাচ্ছেন, তাই সেই সফর সংক্রান্ত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও মিটিংয়ের এজেন্ডায় ছিল।
সেই সব কাগজপত্রের বান্ডিলে তিস্তা চুক্তি সংক্রান্ত একটি খসড়া দেখেই খটকা লাগে ক্যাবিনেটে তৃণমূল কংগ্রেসের একমাত্র সদস্য, দেশের রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদীর।
তৃণমূল তার মাত্র তিন-চার মাস আগেই ইতিহাস গড়ে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় এসেছে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন মমতা ব্যানার্জি।
বৈঠকে মন্ত্রিসভার অনুমোদন চেয়ে চুক্তির যে খসড়াটি পেশ করা হয়েছিল, দীনেশ ত্রিবেদীর সন্দেহ হয়েছিল তা রাজ্য সরকারের সম্মতি ছাড়াই চূড়ান্ত করা হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে বৈঠকে অর্থমন্ত্রী তথা কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় নেতা প্রণব মুখার্জির সঙ্গে তীব্র বাদানুবাদেও জড়িয়ে পড়েন তিনি।
অর্থমন্ত্রী হলেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ব্যক্তিগত সুসম্পর্কের সূত্র ধরে সঙ্গে ভারতের হয়ে তিস্তা চুক্তির বিষয়টি মূলত মি. মুখার্জিই তখন দেখছিলেন।
মি ত্রিবেদী যখন জানতে চান ওই চুক্তিতে রাজ্য সরকারের সম্মতি নেওয়া হয়েছে কি না, প্রণব মুখার্জির তখন বলেছিলেন, যেহেতু ভারতের সঙ্গে আর একটা স্বাধীন দেশের চুক্তি হচ্ছে - এটি একটি আন্তর্জাতিক বিষয়। এখানে রাজ্য সরকারের মতামত জরুরি নয়।
মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থিত একজন সিনিয়র সদস্য ঘটনাটি বিবিসির কাছে বর্ণনা করেন।
বৈঠক শেষ করেই দীনেশ ত্রিবেদী সোজা কলকাতায় ফোন করেন মুখ্যমন্ত্রীকে। সব জানানো মাত্র মমতা ব্যানার্জি তাঁকে বলেন, খসড়া চুক্তির কাগজপত্র সেই রাতেই তাঁকে ফ্যাক্স করে পাঠাতে।
কাগজপত্র দেখেই ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি তখনই বলেন, বাংলাদেশকে তিনি কখনোই শুখা মৌশুমে ৩৩ হাজার কিউসেক জল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেননি – কাজেই তাঁকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে তিস্তা চুক্তির বয়ান প্রস্তুত করা হয়েছে।
পরদিন সকালেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্য সচিব সমর ঘোষ দিল্লিকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দেন, ওই চুক্তি মেনে নেওয়া তাদের পক্ষে কোনও মতেই সম্ভব নয়।
শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সফরসঙ্গী হিসেবে মমতা ব্যানার্জি ঢাকাতেও যাবেন না বলে স্থির করে ফেলেন। ফলে বাংলাদেশের লাগোয়া ভারতের বাকি সবগুলো অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা সেই সফরে গেলেও ছিলেন না শুধু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী।
ওই তিক্ত ক্যাবিনেট বৈঠকের শেষে পরবর্তী দু’তিনদিনে মমতা ব্যানার্জিকে বুঝিয়েসুঝিয়ে রাজি করানোর কম চেষ্টা করেনি দিল্লি।
প্রণব মুখার্জি নিজে তো বটেই, ক্যাবিনেটে তাঁর সতীর্থ জয়রাম রমেশ থেকে শুরু করে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (এনএসএ) শিবশঙ্কর মেনন সকলেই বারবার ফোন করে তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেন “আপাতত এই চুক্তিতে রাজি হয়ে যান – পরে পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ যাতে সুরক্ষিত থাকে সেটা আমরা নিশ্চয় দেখব।”
কিন্তু না, কোনও অনুরোধ-উপরোধেই টলানো যায়নি মমতা ব্যানার্জিকে। তাঁর সাফ কথা ছিল, ওই আকারে চুক্তিটি মানা সম্ভব নয়।
শেষ পর্যন্ত ঢোঁক গিলে দিল্লিও স্বীকার করে নেয়, প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরে এবারে আর তিস্তা চুক্তি সই করা যাবে না।
মনমোহন সিং যেদিন ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেবেন, তার আগের দিন বিকেলেই পররাষ্ট্র সচিব রঞ্জন মাথাই সে কথা নিশ্চিত করে সাংবাদিকদের বলেন, “জল আসলে অতি স্পর্শকাতর একটি বিষয়। আর ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে আমরা এমন কিছু্ই করতে পারব না, যাতে রাজ্য সরকারের আপত্তি আছে।”
ভারত সরকারের ওই ‘উপলব্ধি’র পর ঠিক এক যুগ কেটে গেছে – সেই অবস্থানে কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনও নড়চড় হয়নি।
জয়ন্ত ঘোষালের মতে, এর অবশ্য কিছু নির্দিষ্ট কারণও ছিল।
প্রথমত, কংগ্রেসের রাজনীতিতে একটা সময় মমতা ব্যানার্জি ছিলেন প্রণব মুখার্জির কন্যাসমা। আলাদা দল তৃণমূল গড়ার পরেও মমতা ব্যানার্জি তাঁকে অনেকটা অভিভাবকের মতোই দেখতেন – এবং প্রণব মুখার্জি হয়তো ধরেই নিয়েছিলেন মমতা তাঁর কথা কিছুতেই ফেলতে পারবেন না।
“বস্তুত ওই চুক্তির সম্পাদনে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর খুব বড় একটা ভূমিকা ছিল। প্রণববাবুরা হয়তো ভেবে নিয়েছিলেন, গঙ্গা চুক্তিতে পশ্চিমবঙ্গ যেহেতু সায় দিয়েছে তাই তিস্তাতেও তারা অরাজি হবে না”, বলছিলেন জয়ন্ত ঘোষাল।
জাঁদরেল কূটনীতিক ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শিবশঙ্কর মেনন তখন দেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টা। মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে কথা বলে তাঁকে ‘ড্যামেজ কন্ট্রোলে’র যে দায়িত্ব দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার, সেটাও কোনও কাজে আসেননি।
“মি মেনন বিন্দুমাত্র বাংলা বোঝেন না, চোস্ত ইংরেজিতে কথা বলেন। মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে তাঁর যে কোনও কেমিস্ট্রি গড়ে ওঠেনি এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই”, বিবিসিকে বলছিলেন সেই সময়কার ঘটনাবলীর সাক্ষী একজন সরকারি কর্মকর্তা।
এই প্রতিবেদনের জন্য এখন অবসরপ্রাপ্ত শিবশঙ্কর মেননের বক্তব্য জানতে চেয়ে বারবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি কথা বলতে চাননি।
কিন্তু মমতা নিজে যেহেতু জনমানুষের রাজনীতি করেন, তাই যে পদক্ষেপকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের স্বার্থবিরোধী বলে মনে করা হতে পারে – সেটাতে সায় দেওয়া তাঁর পক্ষে কিছুতেই সম্ভব ছিল না, আর তিনি দেনওনি।
দ্বিতীয়ত, এই ঘটনার ঠিক পনেরো বছর আগে ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী দেবেগৌড়ার আমলে বাংলাদেশের যে গঙ্গা জলচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল তাতে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সানন্দ সম্মতি ছিল।
তবে সে সময় ভারতের জলসম্পদ মন্ত্রী ছিলেন যিনি, সেই পবন কুমার বনসল অবশ্য বিবিসির কাছে স্বীকার করেছেন তাঁর মন্ত্রণালয় চুক্তির খসড়া প্রস্তুত করলেও মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে তাঁর একবারও সে বিষয়ে কোনও কথাবার্তা হয়নি।
চন্ডীগড় থেকে প্রবীণ ওই কংগ্রেস নেতা বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “পুরো ঘটনাটা যখন ঘটছে, আমার সঙ্গে একবারও মমতা ব্যানার্জির দেখা হয়নি বা কথা হয়নি। এখন মনে হয় হলে হয়তো ভাল হত।”
মি বনসল আরও জানাচ্ছেন, প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরে চুক্তিটা সই হয়ে যাবে এ ব্যাপারে তারা খুবই আশাবাদী ছিলেন। শেষ পর্যন্ত সেটা না-হওয়াতে সরকার খুবই হতাশ হয়েছিল।
তবে এটাকে তিনি ঠিক মনমোহন সিং সরকারের ব্যর্থতা বলে মানতে রাজি নন।
“দেখুন, আপনি অনেকগুলো কাজ নিয়ে ঝাঁপালে কোনওটায় সফল হবেন, কোনওটায় হয়তো হবেন না। এটাও সে রকমই একটা, আমি বিষয়টাকে ওই রকম নির্লিপ্তি দিয়েই বিচার করতে চাই”, হাসতে হাসতে বলছিলেন পবন কুমার বনসল।
তবে গোটা বিষয়টা যে ভারত সরকারের কাছে চরম অস্বস্তিকর ছিল, সেটা সে সময়কার কর্মকর্তাদের মন্তব্যেই আজও স্পষ্ট।
যেমন সে সময় ঢাকায় ভারতের হাই কমিশনার ছিলেন রাজিত মিটার। চুক্তি সম্পাদনে ব্যর্থতা নিয়ে তাঁর কাছে জানতে চাইতেই সাবেক ওই কূটনীতিক মার্জনা চেয়ে নেন, “আমাকে দয়া করে ছেড়ে দিন, আমি ওগুলো নিয়ে কথা বলতে পারব না।”
“আসলে অনেক দিন আগের কথা তো, আমি সে সব ভুলেও গেছি!”, জানান মি মিটার।
<p>সম্পাদক ও প্রকাশক: লিটন হোসাইন জিহাদ</p>
© PothikTV Media Center