তিতাস নদীর ঐ পাড়ে সিতানগর আর কাশি নগর গ্রাম ; চরবাসীদের মনে এক বুক স্বপ্ন


রাবেয়া জাহানঃ এই পাড়ে শহর আর ঐ পাড়ে গ্রাম, মাঝখানে তিতাস নদী ঐ বয়ে চলে যায়।
তিতাস-বিধৌত ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় রয়েছে ৯ টি উপজেলা এবং ১৩২৩ টি গ্রাম।তবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সদর উপজেলার পূর্ব মেড্ডায় তিতাস নদীর এ পাড় এবং ঐ পাড়ের ব্যবধানে রয়েছে শহর এবং গ্রাম, মান্নাদের গানটির সাথে তাল মিলিয়ে বলা চলে এই পাড়ে শহর আর ঐ পাড়ে গ্রাম, মাঝখানে নদী ঐ বয়ে চলে যায়।
হ্যা, পূর্ব মেড্ডার তিতাস নদীর ঐ পাড়ে রয়েছে বিচ্ছিন্ন দুটি ভূখন্ড, একটির নাম কাশিনগর এবং অন্যটির নাম সিতানগর। শহরের সাথে গ্রামের সংযোগ স্থাপনের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে নৌকা। নৌকা ছাড়া সিতানগর এবং কাশিনগর গ্রামের মানুষের জীবন একেবারেই স্থবির।
কুয়াচ্ছন্ন সকালেই শুরু হয় তাদের কর্ম জীবন, সেই ভোরবেলায় নৌকা করে ছুটে পড়ে যার যার কর্মস্থলে। সিতানগর গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ মাছ ধরে , কৃষিকাজ এবং শ্রমিকের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে জীবন যাপন করছে।
প্রায় দশহাজার জনবসতিপূর্ণ সিতানগর গ্রামে রয়েছে একটি মন্দির এবং এবং একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
তাদের সাথে বলে জানা যায়, তাদের অনেকেরই ঘর নেই, পরের জায়গায় থাকছে। অনেকের স্বামী নেই, রোজগার করার মানুষ নেই, অত্যন্ত দুঃখ দুর্দশার মধ্য দিয়ে তারা জীবন যাপন করছে।
তবে বর্তমান প্রজন্ম আত্মনির্ভশীল হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। তারা বিচ্ছিন্নতা এবং দারিদ্রতার সকল সীমা অতিক্রম করে সভ্যতার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে চায়। এই কচি বয়সের ছেলে মেয়েগুলোর মনে অনেক স্বপ্ন। তারাও আর দশটা ছেলে মেয়ের মতো এগিয়ে যেতে চায় বহুদূর। কিন্ত বেশির ভাগ ছেলে মেয়েরা প্রাথমিক শিক্ষার পর আর আর শিক্ষা লাভের সুযোগ পায় না। প্রথমত দারিদ্রতা এবং
দুর্বল যোগাযোগের কারণে ছেলে মেয়েরা তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারছে না।
সিতানগর গ্রামের এক ঝাক তরুনী নির্ভশীলতার শেকল ভেঙ্গে আত্মনির্ভশীল হওয়ার লক্ষ্যে কারুশিল্পে দক্ষতা অর্জন করে। তারা এপ্লিক ব্লক এবং আরো নানান ধরনের হাতের কাজের উপর প্রশিক্ষণ নিয়েছে। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এই কারুশিল্পে সীতানগর গ্রামের মেয়েরা অনেকটাই পারদর্শী হয়ে উঠে। কয়েকজন মেয়ে তাদের মেধার অসাধরণ নমুনা দেখিছেন। এই কাজ করে তারা বাণিজ্যিকভাবে লাভবান ও হচ্ছিল, কিন্ত ভাগ্যের নির্মম পরিহাস , করোনা পরিস্থিতিতে ব্যবসা মন্দা চলায় তাদেরকে আবারো ঘরে বসতে হয়েছে। তাদের এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তালা বন্ধ। স্বপ্ন পূরণ হয়েও যেনো হলো না।
তারা যে সকল হাতের কাজ শিখেছ্র, দেশের বাইরেও এইসবের অনেক চাহিদা রয়েছে। তাদের কাজগুলো যদি একটু পৃষ্টপোষকতা পেতো, তাহলে তারা স্বাবলম্বী হয়ে মাথা উচু করে বেচে থাকতে পারতো।
নৌপথে যাতায়াতে অনেকেরই তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। এই গ্রামে হাই স্কুল না থাকায়, পঞ্চম শ্রেনীর পর শিক্ষাথীদের হাইস্কুলে পড়ার জন্য নদী পাড় হতে হয়, এই জন্য অনেকেই পড়াশুনা ছেড়ে দেয়, আর যারা চালিয়ে যায়, তারা অনেক বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে পড়াশুনা করছে। এই নৌপথে অনেক শিক্ষার্থীর একাধিকবার নৌকা ডুবার অভিজ্ঞতা রয়েছে। নৌকা ডুবে গেলে যারা সাতাড় জানে না, তাদেরকে দলের অন্যেরা টেনে তুলে উদ্ধার করে। এতে জীবন বেচে গেলেও বই খাতা উদ্ধার করা আর সম্ভব হয় না, আর এই দারিদ্রতায় নতুন বই খাতা কিনে পড়াশোনায় চালিয়ে যাওয়া তাদের জন্য অনেক কষ্টকর হয়ে যায়। এমন করে অনেক শিক্ষার্থীর বহুবার নৌকা ডুবার অভিজ্ঞতা রয়েছে।
তাছাড়া কর্মীদের কেউ কাজ শেষ করতে দেরি হলে নৌকা মিস করলে সারা রাত নদীর ঐ পাড়ে দাড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়। তাছাড়া পেশায় যারা জেলে তাদের জীবন খুবই চেলেঞ্জিং । এই শীতের মধ্যে সারা রাত জেলেরা মাছ ধরে, সকালে বাজারে বিক্রি করে।
মরার উপর খড়ার ঘা। নৌ পাড়াপাড় হয়ে, তারা শহরে যেখানে এসে থামে, সেখানে রয়েছে ময়লার বার্গার । শহুরের সকল ময়লা আবর্জনা এখন তিতাস নদীতে। এই ময়লা আবর্জনা একদিকে নদীকে ধ্বংস করছে, অন্যদিকে এই নির্যাতিত মানুষগুলোর কষ্ট আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে,
নাক বন্ধ করে দৌড়িয়ে কোনো রকমে এিই পথ তাদেরকে পাড়ি দেয়।
সিতানগর গ্রামের মেম্বার নির্মল চন্দ্র রায় বলেন,
দূর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্যই এই গ্রামের ছেলে মেয়ারা পড়াশুনায় পিছিয়ে আছে।
তিনি বলেন, সীমনা বিবাড়িয়া যে সড়কটি হচ্ছে,সেই সড়কের সংলগ্ন একটি রাস্তা যদি হয়, তাহলে শহরের সাথে এই দুই গ্রামের যোগাযোগ অনেক সহজ হয়ে যাবে, এতে সবার দুঃখ দুর্দশা দূর হবে।
জীবন যতো কঠিন আর চ্যালেঞ্জিং হোক , জীবন তো বয়ে যায়, কোনো কিছুর জন্যই থেমে থাকে না। বাংলাদেশ উন্নয়নের গতিতে এগিয়ে চলছে। আর এই উন্নয়নের ছোয়ায় কাশিনগর এবং সীতানগরের মানুষের স্বপ্ন পূরণ হবে, তারা ও ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবে, সরকারী চাকুরিজীবী হবে, এই প্রত্যাশা তাদের চোখে মুখ ।