ধর্মীয় সংগঠন কী ও কেন ? কুরআন, হাদীস ও ইতিহাসের আলোকে সমাজ গঠনের বাস্তব পাঠ

লেখক: দেলোয়ার হোসাইন মাহদী
প্রকাশ: ৪ সপ্তাহ আগে

ধর্মীয় সংগঠন কী ও কেন ? কুরআন, হাদীস ও ইতিহাসের আলোকে সমাজ গঠনের বাস্তব পাঠ

 

ভূমিকা: সময়ের সন্ধিক্ষণে এক নতুন প্রত্যয়

 

আমরা আজ এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে কেবল সময় নয়—আমাদের ভবিষ্যৎও আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

আমাদের প্রিয় গ্রাম উজানিসার অন্যান্য গ্রামের মতোই, যেখানে সূর্য প্রতিদিন উঠছে, আবার অস্তও যাচ্ছে। কিন্তু সেই আলো আজও পৌঁছেনি আমাদের সমাজের প্রতিটি কোণে। কারণ, এখনো রয়ে গেছে অন্ধকার—ধর্মীয় বিভাজন, মতানৈক্য, পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সহানুভূতির অভাব।

 

তাহলে প্রশ্ন আসে—

আমরা কি এই বিভেদপূর্ণ সমাজকেই ভবিষ্যতের পথ দেখাতে চাই?

আমরা কি চাই আমাদের সন্তানরা বেড়ে উঠুক দ্বন্দ্ব, অবিশ্বাস আর শূন্যতায় ভরা এক সমাজে ?

 

না, ভাই ও বোনেরা!

আমরা সেই সমাজ চাই না। তাই আমরা আজ একটি নতুন স্বপ্ন নিয়ে পথচলা শুরু করছি—একটি আদর্শ, ঐক্যবদ্ধ ও নৈতিক সমাজ গঠনের লক্ষ্যে একটি ধর্মীয় সংগঠন গড়ে তোলা।

 

ধর্মীয় সংগঠন : ধারণা ও গুরুত্ব

 

ধর্মীয় সংগঠন মানে শুধু মসজিদভিত্তিক আচার-অনুষ্ঠান নয়, বরং এটি একটি সামাজিক পুনর্জাগরণের প্ল্যাটফর্ম।

এটি এমন একটি কাঠামো, যার মাধ্যমে মানুষ ধর্মীয় জ্ঞানে শিক্ষিত হয়, নৈতিকভাবে সুদৃঢ় হয় এবং পারস্পরিক সহানুভূতি ও সহযোগিতায় সমাজে মানবিকতা ফিরিয়ে আনে।

 

আমাদের সংগঠনের মূল লক্ষ্যসমূহঃ

 

(ক) ধর্মীয় সহনশীলতা ও ঐক্য গড়ে তোলা (খ) শিশু-কিশোর ও যুবসমাজকে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা (গ) সমাজসেবা ও মানবতার ভিত্তিতে একে অপরের পাশে দাঁড়ানো

 

ইতিহাসের আলোকবর্তিকা : নবী ﷺ থেকে আজকের আন্দোলন –

 

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—সংগঠনের মাধ্যমেই সমাজ পরিবর্তন এসেছে।

রাসূলুল্লাহ ﷺ যখন মদীনায় হিজরত করেন, তখন সমাজ ছিল বিভক্ত, জুয়া, মদ ও হিংসায় নিমজ্জিত। তিনি একটি সুসংগঠিত ইসলামি সমাজ গড়ে তুলেই সমাজকে বদলে দেন।

 

ইতিহাসের কিছু উল্লেখযোগ্য সাংগঠনিক আন্দোলন :

 

হযরত উমর (রাঃ)-এর শাসন ও সমাজ সংস্কার

 

ইমাম গাজ্জালির (রহঃ)-এর দাওয়াতি আন্দোলন (১১শ শতক)

 

শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ)-এর সংস্কার (১৮শ শতক)

 

১৯১৯ সালের খিলাফত আন্দোলন

 

সাম্প্রতিক বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন

 

এসব উদাহরণ প্রমাণ করে, সমাজ পরিবর্তনের জন্য সাংগঠনিক পদ্ধতির কোনো বিকল্প নেই।

 

কুরআন ও হাদীসের দৃষ্টিতে সংগঠনের গুরুত্ব –

 

কুরআনের নির্দেশনা:

 

١) وَلۡتَكُن مِّنكُمۡ أُمَّةٞ يَدۡعُونَ إِلَى ٱلۡخَيۡرِ وَيَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَيَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِۚ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ

 

অর্থ : “আর তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত, যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে, সৎকাজের আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে। তারাই সফলকাম।”

 

— সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১০৪

 

٢) وَلَا تَلۡبِسُواْ ٱلۡحَقَّ بِٱلۡبَٰطِلِ وَتَكۡتُمُواْ ٱلۡحَقَّ وَأَنتُمۡ تَعۡلَمُونَ

أَتَأۡمُرُونَ ٱلنَّاسَ بِٱلۡبِرِّ وَتَنسَوۡنَ أَنفُسَكُمۡ وَأَنتُمۡ تَتۡلُونَ ٱلۡكِتَٰبَۚ أَفَلَا تَعۡقِلُونَ

 

অর্থ : “তোমরা সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশিয়ে দিও না এবং জেনে-বুঝে সত্য গোপন করো না।

তোমরা কি মানুষকে সৎকাজের নির্দেশ দাও অথচ নিজেদের ভুলে যাও? অথচ তোমরা তো কিতাব পাঠ করো! তবে কি তোমরা বুঝবে না?”

 

— সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৪২–৪৪

 

 হাদীসের নির্দেশনা :

 

١) مَن رَأَى مِنكُم مُنكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ، فَإِن لَّمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ، فَإِن لَّمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ، وَذَلِكَ أَضْعَفُ الإِيمَانِ

 

অর্থ : “তোমাদের কেউ যদি কোনো মন্দ কাজ দেখে, তাহলে সে তা হাত দিয়ে প্রতিরোধ করুক। যদি না পারে, তাহলে মুখে বলুক। যদি এটাও না পারে, অন্তর দিয়ে ঘৃণা করুক—এটাই ঈমানের সবচেয়ে দুর্বল স্তর।”

 

— সহীহ মুসলিম, হাদীস: ৪৯

 

٢) إِنَّ النَّاسَ إِذَا رَأَوْا الظَّالِمَ فَلَمْ يَأْخُذُوا عَلَى يَدَيْهِ أَوْشَكَ أَنْ يَعُمَّهُمُ اللَّهُ بِعِقَابٍ مِنْهُ

 

অর্থ : “যখন কোনো জাতি অন্যায়কারীর অন্যায় দেখে আর তাকে থামায় না, তখন অচিরেই আল্লাহ সবাইকে তাঁর পক্ষ থেকে শাস্তি দিয়ে ঘিরে ফেলেন।”

 

— সুনান আবু দাউদ, হাদীস: ৩৭৮৮

 

٣) مَنْ لَيْسَ عَلَيْهِ إِمَامٌ جَمَاعَةٌ فَإِنَّهُ كَشَاةٍ ضَلَّتْ، تَفْتِرِسُهَا الذِّئَابُ

 

অর্থ : “যার উপর কোনো নেতা (ইমাম) নেই, সে যেন পথভ্রষ্ট একটি ভেড়ার মতো, যাকে বনের নেকড়ে বাঘ ছিঁড়ে খায়।”

 

— মুসনাদ আহমাদ, হাদীস: ১৭৭৬৩

 

সংগঠন : একটি স্বপ্নের আলো

 

একটি সংগঠন রাতারাতি সমাজ বদলাতে পারে না, কিন্তু এটি থেকেই পরিবর্তনের সূচনা হয়।

এটি হয়ে ওঠে: (ক) আলোর কেন্দ্র (খ) সহানুভূতির আশ্রয় (গ) ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক

 

আমরা আজ শুধু একটি সংগঠন গড়ছি না—আমরা গড়ছি আগামী প্রজন্মের জন্য একটি নৈতিক ও মানবিক ভিত্তি।

 

 উপসংহার : এসো এক হই, সমাজ বদলাই

 

সম্মানিত পাঠক/পাঠিকা,

আমরা যদি সত্যিকার অর্থে সমাজে পরিবর্তন আনতে চাই, তাহলে এখনই সময়। এসো, দলাদলি ভুলে যাই,

এসো, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নতুন স্বপ্নের পথে হাঁটি।

 

ধর্ম আমাদের বিভক্ত করতে আসেনি, বরং ঐক্যবদ্ধ করতে এসেছে।

আজ যে প্রদীপ আমরা জ্বালাচ্ছি, তা-ই হবে আগামী দিনের আলোর দিশারি।

এই সংগঠন হবে আমাদের আশার ঘর, বিশ্বাসের ঠিকানা।

 

আসুন, আমরা এক হই—গড়ি এক শান্তিপূর্ণ, ঐক্যবদ্ধ, নৈতিক সমাজ।

আল্লাহ তা’আলা আমাদের সহায় হোন, আমীন।

 

দেলোয়ার হোসাইন মাহদী

(আলেম ও সাংবাদিক)

📧 islamicreports@gmail.com

 

  • ইসলাম ধর্মীয় সংগঠন কুরআনের আলোকে হাদীসের আলোকে ইসলামিক সমাজব্যবস্থা ইসলামী ইতিহাস সমাজ গঠন ইসলামী চিন্তাধারা মুসলিম উম্মাহ ইসলামী শিক্ষা ইসলামের দর্শন সংগঠন ও নেতৃত্ব ইসলামি সমাজনীতি