সৃষ্টিকর্তা স্ত্রী ও পুরুষ এ দুটি শ্রেণির সমন্বয়ে মানুষ জাতিকে সৃষ্টি করেছেন। আমি ‘স্ত্রী’ শব্দটি আগে উচ্চারণ করলাম স্ত্রী মানুষটি দীর্ঘ ৯ মাস ১০ দিন তার গর্ভে স্ত্রী বা পুরুষ ‘মানুষ’টিকে ধারণ করে। বিভিন্ন ভোগান্তির পর একজন মানুষকে জন্মদান করে পরম তৃপ্তিতে অনেক সময় নিজে না খেয়ে তাকে বড় করে তোলে।
বিজ্ঞাপন
এ কথাগুলো চন্দ্র-সূর্যের মতো সত্য। আমরা সবাই তা জানি, কিন্তু বিষয়টাকে পরিচর্যা করি না, বোধের মধ্যে আনতে দ্বিধা বোধ করি। বিংশ শতকের প্রথম চারটি দশকে নারীদের বিভিন্ন দিক দিয়ে যখন বেশামাল অবস্থা।
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন
নজরুলসংগীত নিয়ে ড. লীনা তাপসী খানের ২ বই
পারিবারিক, আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি দিকসমূহে তখন থেকেই কবিরা বিভিন্নভাবে সাহিত্যে, কবিতায় নারীকে মর্যাদার সঙ্গে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তার সাহিত্য জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নারীকে প্রাণভরা সহানুভূতি দিয়েছেন। তার রচিত মানসী কবিতায় বলেন, ‘শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী, পুরুষ গড়েছে তোমা সৌন্দর্য সঞ্চারী’। তার মতে আপন অন্তর হতে পুরুষের গড়া নারীরা তাই অর্ধেক মানবী তুমি, অর্ধেক কল্পনা। এই অর্ধেক মানবীরা যখন অন্তঃপুরবাসিনী হয়ে নানান নির্যাতনে নিগৃহীত হয় তখন তাদের জন্য তার হৃদয়ে হাহাকার ওঠে বৈকি।
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন
নতুন পরিচয়ে লীনা তাপসী খান
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যুক্ত করে সত্যেন্দ্রনাথের কথাও স্বীকার করতে হয়। সমাজের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীদের প্রতি যে অন্যায়, অবিচার, লাঞ্চনা, গঞ্জনা চলে তা অবলোকনে ভারাক্রান্ত কবি।
নজরুলসংগীতে নারী
তার কাছে মনে হয়েছে ‘সমাজে কন্যারা ঘরের আবর্জনা, পয়সা দিয়ে ফেলতে হয়’ বিয়ের অনুষ্ঠানে যৌতুকের বলি দিয়ে তাকে বিদায় করার প্রথা থেকে আজও এ সমাজ মুক্তি পায়নি। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মতে নারী সামান্য নয়, অশুচি নয়, সে গানের দেবতা, প্রাণের দেবতা, ধ্যানের দেবতা, বনের পুষ্প, মনের ভক্তি এসবেই উৎস।
বিজ্ঞাপন
অথচ সেই নারী আজও কুসংস্কারের কারাগারে বন্দিনী। মানবতা, সাম্য, ও সহানুভূতিতে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের নারী ভাবনা স্মরণীয়। তার ধারাবাহিকতায় দিজেন্দ্রলাল রায়, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, কবি শেখর কালিদাস রায় এদের কবিতায়ও ভাগ্যাহত, নিপীড়িত নারীকে পাওয়া যায়।
এক পর্যায়ে কালিদাস রায় নারীকে উৎসাহিত ও সাহসী হওয়ার জন্য আহবান করে বলেন- ‘কে বলে তোমারে বন্দী করেছে অন্তঃপুরে পুরুষ সবল, তুমি স্বেচ্ছা-বন্দিনী যে এড়াইতে লোলুপ দৃষ্টি গরল’তারই ধারাবাহিকতায় কাজী নজরুলকে পাওয়া যায় এক অবিস্মরণীয় রূপে। তিনি তার গানে, কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে নানাভাবে ‘নারী’ বিষয়টিকে এনেছেন।
নজরুল ভাবনায় সর্বপ্রথম আসে নারী মহৎ সৃষ্টির অংশভাগ, তার জন্যে বিধাতার সমস্ত সৃষ্টি উন্মুখ। শুধু বিশ্ব নয় মহাবিশ্ব, অনন্ত চরাচরেও নারীদের সমান ঠাঁই। প্রতিটি গানই একটি শ্রেষ্ঠ কবিতা। প্রথমত, কাজী নজরুল একজন ‘কবি’, শুধু গীতিকার নন এবং কবিতাই তার প্রথম আত্মবিকাশ কেন্দ্র।
বিজ্ঞাপন
তাই কবিতা এখানে আসবেই। তার রচিত সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থটিতে ‘নারী’ বিষয়টি সবচেয়ে জোরালোভাবে দাবির সঙ্গে, প্রতিবাদের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। তিনি বলেছেন -‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’।
বলেছেন- এ মহীয়ান বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অর্ধেক রয়েছে নারী। এক পর্যায়ে তার নারী কবিতায় বিশ্লেষণ করে বলেন- ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’।
এ দুটি লাইন বিশ্লেষণই বোদ্ধা মানুষের জন্যে যথেষ্ট কিন্তু নির্বোধ মনুষ্য জাতি আমরা বুঝেও না বোঝার ভান করায় ব্যস্ত সবাই। কবি নজরুল বারাঙ্গনাদের নিয়েও জোরালো কবিতা সৃষ্টি করেছেন। শত পাপ পঙ্কিল সমাজে শুধু বারাঙ্গনারা কেন দায় ভার নেবে?
নজরুলসংগীতে নারী
কবি তাদের প্রশ্ন ছুড়েছেন- ‘অসতি মাতার পুত্র সে যদি জারজ পুত্র হয় অসৎ পিতার সন্তানও তবে জারজ সুনিশ্চয়!’
নারীকে যদি পতিতা বলা যায় নরকেও বলা যায়। কবি নজরুল পতিতাদেরও দ্বাররুদ্ধ করার বিরুদ্ধে, পাপ করেছে বলে পুণ্যের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া যাবে না। নর-নারীকে সামাজিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠার লক্ষেই বারাঙ্গনা কবিতার জন্ম।
নজরুল তার সৃষ্টিকর্মে এই প্রেম কাহিনিগুলোকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করে গান রচনা করে গেছেন। লাইলী, শিরী, রাধা, আনারকলি, মমতাজ ইত্যাদি।
যুগে যুগে ঐতিহাসিক বীরত্বে এগিয়ে আসে বারংবার। কাজী নজরুলের মাত্র ২২ বছরের সৃষ্টি সম্ভারে তাদের পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে গেছেন তার সাহিত্য কর্মে ও সংগীতে। তার গানে যে সকল নারীর উল্লেখ পাওয়া যায় তাদের মধ্যে চাঁদ সুলতানা, নুরজাহান, মমতাজ, রিজিয়া, জেবুন্নেসা, লায়লা ওহাবী, সাকিনা, জাহানারা, খালিদা অন্যতম। গুণে গরিমায় আমাদের নারী আদর্শ দুনিয়ায় এই গানটির মধ্যে বেশকিছু নাম পাওয়া যায়।
পরিশেষে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বলা যায় যে কাজী নজরুল ইসলাম তার সংগীতে নারীদের পূর্ণ মর্যাদায় সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন তার সংগীত ও সাহিত্যের মাধ্যমে। পুরুষ শাসিত সমাজে নারীকে সু-সাম্যবাদ রূপে প্রতিষ্ঠার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করে ধন্য করেছেন নারীকূলকে। যুগে যুগে এই আত্মজিজ্ঞাসা যেন অব্যাহত থাকে।
লেখক: নজরুলসংগীত শিল্পী ও অধ্যাপক (সাবেক চেয়ারম্যান, সংগীত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)।
সৃষ্টিকর্তা স্ত্রী ও পুরুষ এ দুটি শ্রেণির সমন্বয়ে মানুষ জাতিকে সৃষ্টি করেছেন। আমি ‘স্ত্রী’ শব্দটি আগে উচ্চারণ করলাম স্ত্রী মানুষটি দীর্ঘ ৯ মাস ১০ দিন তার গর্ভে স্ত্রী বা পুরুষ ‘মানুষ’টিকে ধারণ করে। বিভিন্ন ভোগান্তির পর একজন মানুষকে জন্মদান করে পরম তৃপ্তিতে অনেক সময় নিজে না খেয়ে তাকে বড় করে তোলে।
বিজ্ঞাপন
এ কথাগুলো চন্দ্র-সূর্যের মতো সত্য। আমরা সবাই তা জানি, কিন্তু বিষয়টাকে পরিচর্যা করি না, বোধের মধ্যে আনতে দ্বিধা বোধ করি। বিংশ শতকের প্রথম চারটি দশকে নারীদের বিভিন্ন দিক দিয়ে যখন বেশামাল অবস্থা।
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন
নজরুলসংগীত নিয়ে ড. লীনা তাপসী খানের ২ বই
পারিবারিক, আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি দিকসমূহে তখন থেকেই কবিরা বিভিন্নভাবে সাহিত্যে, কবিতায় নারীকে মর্যাদার সঙ্গে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তার সাহিত্য জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নারীকে প্রাণভরা সহানুভূতি দিয়েছেন। তার রচিত মানসী কবিতায় বলেন, ‘শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী, পুরুষ গড়েছে তোমা সৌন্দর্য সঞ্চারী’। তার মতে আপন অন্তর হতে পুরুষের গড়া নারীরা তাই অর্ধেক মানবী তুমি, অর্ধেক কল্পনা। এই অর্ধেক মানবীরা যখন অন্তঃপুরবাসিনী হয়ে নানান নির্যাতনে নিগৃহীত হয় তখন তাদের জন্য তার হৃদয়ে হাহাকার ওঠে বৈকি।
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন
নতুন পরিচয়ে লীনা তাপসী খান
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যুক্ত করে সত্যেন্দ্রনাথের কথাও স্বীকার করতে হয়। সমাজের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীদের প্রতি যে অন্যায়, অবিচার, লাঞ্চনা, গঞ্জনা চলে তা অবলোকনে ভারাক্রান্ত কবি।
নজরুলসংগীতে নারী
তার কাছে মনে হয়েছে ‘সমাজে কন্যারা ঘরের আবর্জনা, পয়সা দিয়ে ফেলতে হয়’ বিয়ের অনুষ্ঠানে যৌতুকের বলি দিয়ে তাকে বিদায় করার প্রথা থেকে আজও এ সমাজ মুক্তি পায়নি। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মতে নারী সামান্য নয়, অশুচি নয়, সে গানের দেবতা, প্রাণের দেবতা, ধ্যানের দেবতা, বনের পুষ্প, মনের ভক্তি এসবেই উৎস।
বিজ্ঞাপন
অথচ সেই নারী আজও কুসংস্কারের কারাগারে বন্দিনী। মানবতা, সাম্য, ও সহানুভূতিতে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের নারী ভাবনা স্মরণীয়। তার ধারাবাহিকতায় দিজেন্দ্রলাল রায়, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, কবি শেখর কালিদাস রায় এদের কবিতায়ও ভাগ্যাহত, নিপীড়িত নারীকে পাওয়া যায়।
এক পর্যায়ে কালিদাস রায় নারীকে উৎসাহিত ও সাহসী হওয়ার জন্য আহবান করে বলেন- ‘কে বলে তোমারে বন্দী করেছে অন্তঃপুরে পুরুষ সবল, তুমি স্বেচ্ছা-বন্দিনী যে এড়াইতে লোলুপ দৃষ্টি গরল’তারই ধারাবাহিকতায় কাজী নজরুলকে পাওয়া যায় এক অবিস্মরণীয় রূপে। তিনি তার গানে, কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে নানাভাবে ‘নারী’ বিষয়টিকে এনেছেন।
নজরুল ভাবনায় সর্বপ্রথম আসে নারী মহৎ সৃষ্টির অংশভাগ, তার জন্যে বিধাতার সমস্ত সৃষ্টি উন্মুখ। শুধু বিশ্ব নয় মহাবিশ্ব, অনন্ত চরাচরেও নারীদের সমান ঠাঁই। প্রতিটি গানই একটি শ্রেষ্ঠ কবিতা। প্রথমত, কাজী নজরুল একজন ‘কবি’, শুধু গীতিকার নন এবং কবিতাই তার প্রথম আত্মবিকাশ কেন্দ্র।
বিজ্ঞাপন
তাই কবিতা এখানে আসবেই। তার রচিত সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থটিতে ‘নারী’ বিষয়টি সবচেয়ে জোরালোভাবে দাবির সঙ্গে, প্রতিবাদের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। তিনি বলেছেন -‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’।
বলেছেন- এ মহীয়ান বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অর্ধেক রয়েছে নারী। এক পর্যায়ে তার নারী কবিতায় বিশ্লেষণ করে বলেন- ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’।
এ দুটি লাইন বিশ্লেষণই বোদ্ধা মানুষের জন্যে যথেষ্ট কিন্তু নির্বোধ মনুষ্য জাতি আমরা বুঝেও না বোঝার ভান করায় ব্যস্ত সবাই। কবি নজরুল বারাঙ্গনাদের নিয়েও জোরালো কবিতা সৃষ্টি করেছেন। শত পাপ পঙ্কিল সমাজে শুধু বারাঙ্গনারা কেন দায় ভার নেবে?
নজরুলসংগীতে নারী
কবি তাদের প্রশ্ন ছুড়েছেন- ‘অসতি মাতার পুত্র সে যদি জারজ পুত্র হয় অসৎ পিতার সন্তানও তবে জারজ সুনিশ্চয়!’
নারীকে যদি পতিতা বলা যায় নরকেও বলা যায়। কবি নজরুল পতিতাদেরও দ্বাররুদ্ধ করার বিরুদ্ধে, পাপ করেছে বলে পুণ্যের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া যাবে না। নর-নারীকে সামাজিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠার লক্ষেই বারাঙ্গনা কবিতার জন্ম।
নজরুল তার সৃষ্টিকর্মে এই প্রেম কাহিনিগুলোকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করে গান রচনা করে গেছেন। লাইলী, শিরী, রাধা, আনারকলি, মমতাজ ইত্যাদি।
যুগে যুগে ঐতিহাসিক বীরত্বে এগিয়ে আসে বারংবার। কাজী নজরুলের মাত্র ২২ বছরের সৃষ্টি সম্ভারে তাদের পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে গেছেন তার সাহিত্য কর্মে ও সংগীতে। তার গানে যে সকল নারীর উল্লেখ পাওয়া যায় তাদের মধ্যে চাঁদ সুলতানা, নুরজাহান, মমতাজ, রিজিয়া, জেবুন্নেসা, লায়লা ওহাবী, সাকিনা, জাহানারা, খালিদা অন্যতম। গুণে গরিমায় আমাদের নারী আদর্শ দুনিয়ায় এই গানটির মধ্যে বেশকিছু নাম পাওয়া যায়।
পরিশেষে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বলা যায় যে কাজী নজরুল ইসলাম তার সংগীতে নারীদের পূর্ণ মর্যাদায় সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন তার সংগীত ও সাহিত্যের মাধ্যমে। পুরুষ শাসিত সমাজে নারীকে সু-সাম্যবাদ রূপে প্রতিষ্ঠার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করে ধন্য করেছেন নারীকূলকে। যুগে যুগে এই আত্মজিজ্ঞাসা যেন অব্যাহত থাকে।
লেখক: নজরুলসংগীত শিল্পী ও অধ্যাপক (সাবেক চেয়ারম্যান, সংগীত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)।
ইমি/পথিক নিউজ
<p>সম্পাদক ও প্রকাশক: লিটন হোসাইন জিহাদ</p>
© PothikTV Media Center