W3Schools.com  

রাজধানীতে অভিযান আতঙ্কে বন্ধ হচ্ছে রেস্টুরেন্ট

লেখক:
প্রকাশ: ৭ মাস আগে

রাজধানীর বিভিন্ন জায়গার রেস্টুরেন্টে অভিযান পরিচালনা অব্যাহত রেখেছে পুলিশ। গত রোববারের মতো গতকাল সোমবার পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা বা যথাযথ অনুমোদন না থাকার অভিযোগে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এতে কিছু রেস্টুরেন্ট সিলগালা করে দেয়ার পাশাপাশি কয়েকজনকে আটকও করা হয়। এদিন রাজধানীর ধানমন্ডি, জিগাতলা ও ওয়ারির বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে অভিযান চালায় পুলিশ। অভিযান আতঙ্কে অনেক রেস্টুরেন্ট মালিক স্বেচ্ছায় বন্ধ করে দিচ্ছেন।

 

গতকাল ঢাকা মহানগর (ডিএমপি) পুলিশের ওয়ারী বিভাগের আওতাধীন বিভিন্ন আবাসিক ভবনে থাকা রেস্টুরেন্টের বিরুদ্ধে অভিযান করেছে পুলিশ। এতে দেখা যায়, কোনো রেস্টুরেন্টের সিঁড়িতে রাখা হয়েছে গ্যাস সিলিন্ডার, কোনোটিতে রান্নার সামগ্রী। আবার কোনোটির নেই অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা। কোনোটির নেই জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি। বেশিরভাগ রেস্টুরেন্ট চলছে আবাসিক ভবনে।

 

ওয়ারীর র?্যাংকিন স্ট্রিটের ১৪টি রেস্টুরেন্টে পুলিশের অভিযানের সময় এমন চিত্র দেখা গেছে। বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে ১৬ জনকে আটক করা হয়েছে।

 

পুলিশ বলছে, ভয়াবহ অগ্নিঝুঁকি নিয়ে চলছে এসব খাবারের রেস্টুরেন্ট। বেশিরভাগ রেস্টুরেন্টে নেই অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা ও জরুরি বহির্গমনের পথ। এখানে এমনও রেস্টুরেন্ট রয়েছে, যেখানে রান্নাঘর থেকে অন্তত তিনটি দরজা পেরিয়ে সিঁড়িতে আসতে হয়। সেখানে আগুন লাগলে কেউ বের হয়ে আসতে পারবেন না।

 

ওয়ারী থানাসংলগ্ন রোজ ভ্যালি শপিংমলে গতকাল বেলা ৩টা ৪৫ মিনিটে এই অভিযান শুরু হয়। এ ভবনের দোতলার আই লাভ মেজ্জান, তিনতলার ফুড স্টোভ, অরেঞ্জ ক্যাফে, বার্গারোলজি ও বার্গার এক্সপ্রেসে অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু অনিয়ম পেয়েছে পুলিশ। এসব রেস্টুরেন্টের দায়িত্বশীল অন্তত পাঁচজনকে আটক করা হয়।

 

আটক হওয়ার আগে বার্গার এক্সপ্রেসের ব্যবস্থাপক শফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘পুলিশ বলছে, রান্নাঘরের পাশেই বসার জায়গা। এরপর রান্নাঘরে রাখা সিলিন্ডার, এছাড়া ভবনের জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি নেই। আর ভবনের যে সিঁড়ি, সেটিতে আসতে অন্তত তিনটি দরজা পেরোতে হবে। আমরা বলেছি, মালিকপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে যেসব অসামঞ্জস্য আছে, সেগুলো ঠিক করা হবে।’

 

অভিযানের সময় ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার ইকবাল হোসাইন বলেন, ‘আমরা র?্যাংকিন স্ট্রিটের ভবনগুলোয় অভিযান পরিচালনা করছি। আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছে। সেগুলোয় পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা নেই। রেস্টুরেন্টের যেখানে বসে লোকজন খাচ্ছেন, তার পাশেই চুলা ও গ্যাস সিলিন্ডার রাখা হয়েছে। কোনো কোনো ভবনে নেই বহির্গমনের সিঁড়ি। ভবনের সিঁড়ি ছোট ও সিঁড়ির মুখে বিভিন্ন মালপত্র রেখে জায়গা ছোট করে ফেলা হয়েছে।’

 

ইকবাল হোসাইন বলেন, তিনটি রেস্তোরাঁ থেকে ব্যবস্থাপকসহ ছয়-সাতজনকে আটক করা হয়েছে। জব্দ করা হয়েছে কিছু গ্যাস সিলিন্ডার।

 

সব রেস্টুরেন্টই যে অনিয়ম করছে, তা নয় বলেও পুলিশ জানিয়েছে। ইকবাল হোসাইন বলেন, কয়েকটি রেস্টুরেন্ট পাওয়া গেছে, যেগুলো বাণিজ্যিক ভবনে গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে সব ধরনের অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা, জরুরি বহির্গমন সিঁড়িসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা রয়েছে।

 

অন্যদিকে রাজধানীর জিগাতলায় সাতমসজিদ সড়কের পাশের কেয়ারি ক্রিসেন্ট ভবনটি সিলগালা করে দেয়া হয়েছে। ওই ভবনে ১১টি রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করছিল। ভবনের দুটো সিঁড়ির একটি বন্ধ, সেখানে রাখা হয়েছে গ্যাস সিলিন্ডার। আর ভবনের ছাদে তালা লাগানো। ভবনে আগুন লাগলে কারও পক্ষে ছাদে যাওয়া সম্ভব নয়।

 

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাহাঙ্গীর আলম গতকাল সোমবার বিকালে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ভবনটিতে এই অবস্থা দেখতে পেয়েছেন। পরে অগ্নিনিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে ভবনটি সিলগালা করে দিয়েছেন তিনি।

 

গতকাল বিকাল ৪টায় জিগাতলার কেয়ারি ক্রিসেন্ট প্লাজার সামনে গিয়ে দেখা যায়, ঢোকার মুখেই একটি কাগজ ঝোলানো, তাতে লেখা‘সব রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকবে।’

 

ম্যাজিস্ট্রেট জাহাঙ্গীর আলম সাংবাদিকদের বলেন, এটি ১৫তলা ভবন। ১২তলা পর্যন্ত প্রায় সবটাতেই রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এছাড়া দুটো ভবনে ভিসা প্রসেসিং অফিস রয়েছে। তিনি বলেন, ‘ভবনের দুটো সিঁড়ি; তার একটি বন্ধ, ব্যবহার-উপযোগী নয়। সেখানে গ্যাসের সিলিন্ডার রাখা। ছাদও বন্ধ, দুর্ঘটনা ঘটলে কেউ সেখানে যেতে পারবে না।’

 

 

ভবনটি সিলগালা করা ছাড়াও সেখানে থাকা ভিসা প্রসেসিং অফিস থেকে তিন কর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে জানান ম্যাজিস্ট্রেট জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, তারা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত, তাই তাদের আটক ও জরিমানা করা হয়েছে। ভবনের রেস্টুরেন্টগুলোয় কোনো মালিক বা কর্তৃপক্ষের কাউকে পাওয়া যায়নি।

 

অভিযানে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরাও ছিলেন। ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক তানহার ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘এখানে ফায়ার সেফটি প্ল্যান ছিল না। তাই ব্যানার টানিয়ে দেয়া হয়েছে।’

 

এছাড়া রাজধানীর ধানমন্ডির সাতমসজিদ সড়কের গাউসিয়া টুইন পিক ভবনে একটি রুফটপ রেস্টুরেন্ট ভেঙে ফেলা হয়েছে। ওই ভবনের ১২টি রেস্টুরেন্ট সিলগালা করে দিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।

 

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বলছেন, ভবনটিতে অফিস করার অনুমতি থাকলেও রেস্টুরেন্ট করার অনুমতি ছিল না। গত ২৩ মে রাজউক এই ভবন পরিদর্শনে এসে নোটিশ দিয়েছিল।

 

সোমবার রাজউকের অঞ্চল-৩-এর পরিচালক ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাজিনা সারোয়ার এই অভিযান পরিচালনা করেন। বেলা ১১টার পর অভিযান শুরু হয়। তবে এর আগেই ভবনের রেস্টুরেন্টগুলো বন্ধ ছিল।

 

রুফটপের রেত্রো লাইফ কিচেন নামের রেস্টুরেন্টটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাজিনা সারোয়ার বলেছেন, টুইন পিক ভবনটিতে এফ-১-এর অনুমোদন ছিল বলে জানিয়েছেন। অর্থাৎ ভবনটি অফিস হিসেবে ব্যবহার করা যাবে, কিন্তু রেস্টুরেন্ট হিসেবে নয়। এছাড়া কোনো রেস্টুরেন্টই ব্যবসার জন্য জেলা প্রশাসনের অনুমোদন নেয়নি বলে তিনি জানান।

 

যেসব ভবন সিলগালা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সেগুলোর আদেশ ঢাকা জেলা প্রশাসনে বরাবর পাঠানো হবে। তারা পরবর্তী সময়ে ব্যবস্থা নেবে।

 

অভিযানে স্পাইস হারবস নামের একটি রেস্টুরেন্টকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এর মালিক রাইসুল আলম খান বলেন, ‘রেস্টুরেন্ট করা যাবে না, তা জানতাম না। জেলা প্রশাসনের অনুমোদনও জানা ছিল না। বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে রেস্টুরেন্ট করেছি। আমাদের দোষটা কোথায়? এখন আমরা কী করব?’

 

গাউসিয়া টুইন পিক ভবনের ডেভেলপার কর্তৃপক্ষের লজিস্টিক ম্যানেজার শহিদুল ইসলাম বলেন, স্থপতি যেভাবে ভবন নকশা করেছেন, সেভাবেই চলছে। তারা বাণিজ্যিক হিসেবে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে রেস্টুরেন্টের অনুমোদন নিয়েছেন। তবে সেখানে রাজউকের নকশার শর্ত ছিল। রাজউক এফ-১-এর অনুমোদন দেয়। সারা ঢাকায় এফ১ হলেও রেস্তোরাঁ করা যায়, সেটা স্থপতিই বলেছেন বলে জানান তিনি।

 

শহিদুল ইসলাম বলেন, তাদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শুধু এই ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। তারপর এটি ভবন মালিকদের বুঝিয়ে দেয়া হয়। ভবনের মালিক বেশ কয়েকজন। তারা নিজেদের মতো করে রেস্টুরেন্ট ভাড়া দিয়েছেন।

 

রাজউক জানিয়েছে, যেসব রেস্টুরেন্টে কর্তৃপক্ষ পাওয়া গেছে, তাদের জরিমানা করা হচ্ছে। তাদের এ অভিযান চলমান থাকবে।

 

উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজ নামের একটি সাততলা ভবনে আগুন লাগে। ওই ভবনের প্রতিটি তলায় রেস্টুরেন্ট ছিল। সেখানে আগুনের ঘটনায় ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। গুরুতর আহত অবস্থায় এখনও চিকিৎসাধীন পাঁচজন। এ ঘটনার পর ঢাকার বিভিন্ন বাণিজ্যিক ভবনে ইচ্ছামতো রেস্টুরেন্ট তৈরি করা নিয়ে উদ্বেগ জানান বিশেষজ্ঞরা। বিভিন্ন মহল থেকে এসব ভবনে অভিযান চালিয়ে অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টি খতিয়ে দেখার দাবি জানানো হয়।

 

এ পরিস্থিতিতে গত রোববার রাজধানীর গুলশান, মিরপুর ও উত্তরার প্রায় অর্ধশত রেস্টুরেন্টে অভিযান চালিয়ে ২২ জনকে আটক করে পুলিশ। তারপর গতকাল ধানমন্ডি, ওয়ারীসহ বিভিন্ন এলাকার ভবনে একযোগে অভিযান চালাচ্ছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ও পুলিশ।

 

এদিকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেছেন, ‘একটা ঘটনা ঘটার পরে আমরা শোক করি, জ্ঞান দিই। কিন্তু দায়িত্বরত সব সংস্থা নিজেদের কাজ ঠিকমতো করলে অগ্নিকাণ্ডে বেইলি রোডসহ অতীতে যেসব প্রাণহানি ঘটেছে সেগুলো দেখতে হতো না। তাই এবার ডিএমপির থানা-পুলিশ ও ডিবি পুলিশ রাজধানীর বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে নজর রাখছে, যাতে যথাযথ অগ্নিনিরাপত্তা ও দুর্ঘটনা ঘটলে বের হওয়ার পথ রয়েছে কিনা।’ সোমবার দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন।

ইমি/ পথিক নিউজ