✧ শেষ চিঠি ✧
তুমি কি কখনও দেখেছো—
একটা চিঠি উড়তে উড়তে
ঘুমন্ত নক্ষত্রের গায়ে গিয়ে পড়ে?
সে চিঠির খামে ছিল না কোনো নাম,
না প্রেরকের, না প্রাপকের—
তবুও লেখা ছিল— “তোমারই জন্য, মৃত্যুরও পরে!”
আমি সে চিঠির কালি দিয়ে রক্ত লিখেছিলাম,
কবুতরের ডানায় বেঁধে দিয়েছিলাম শেষ নিশ্বাস।
রাতদুপুরে এক সমাধির ভেতর থেকে
সে উড়ে গিয়েছিল তোমার আয়নার কাছে।
তুমি তাকিয়ে ছিলে, কিন্তু দেখোনি।
তুমি ছুঁয়ে ছিলে, কিন্তু পড়োনি।
হে আমার অভিশপ্ত প্রেম!
যার ঘ্রাণে ঘুম ভেঙে যায় স্বর্গেরও—
তোমার ঠোঁটের নিচে কি এখনো কাঁপে আমার নাম?
নাকি ওখানে নতুন কারো বসতি?
আমি তো কবেই মরে গেছি—
এখন শুধু প্রেতাত্মা হয়ে ঘুরি তোমার অশরীরি লিপস্টিকে।
তোমার চুলের জটিল গ্রন্থিতে আমি এখন
একটা ছিন্ন পোকা—
যে জানে, সে আর ফিরবে না কখনো পূর্ণ পুষ্পে।
তুমি কাঁদলে না—
তুমি তো কাঁদো শুধু আয়নার সামনে,
যেখানে প্রেম মানে শুধু সাজ,
আর চিঠির মানে একটি ক্যাপশনমাত্র।
“আমি আত্মহত্যা করিনি,
আমি তোমার ভালোবাসায় ডুবে গিয়েছিলাম—
যেখানে বেঁচে থাকাটাও ছিল একধরনের মৃত্যুবরণ।”
✧ মৃত্যু’র পরে ভালোবাসা ✧
আমার কবরের উপর যখন প্রথম বৃষ্টি পড়ল,
সেই জল তোমার চোখের নয়— ঠোঁটের প্রাক্তন হাসির ধস।
শুধু আমি শুনতে পেয়েছিলাম—
একটা বাতাস ডেকে উঠেছে,
“সে এখনও ভালোবাসে… মৃত মানুষটিকে!”
হে অন্ধ সময়,
তুমি কি জানো, মৃত্যুর পরে
আমি কেমন করে বেঁচে আছি ওর স্বপ্নে?
প্রতি রাতে সে দরজা বন্ধ করে,
আর আমি স্লিপারের নিচে এক টুকরো ছায়া হয়ে
তার পায়ের তলায় পড়ে থাকি।
ভালোবাসা বোঝে না গোরস্তান আর ড্রয়ারের পার্থক্য।
তুমি আবার প্রেমে পড়েছো—
আমি জানি, আমি নিজে গিয়েছিলাম খামে বন্দী আশীর্বাদ হয়ে।
তবু প্রতিদিন আমার বিছানায়
কোনো অজানা সুগন্ধ ভেসে আসে—
সেই সুগন্ধ, যেটা তুমি একদিন আমার বুকের উপর রেখেছিলে
আঁচলের মতো।
তুমি আর কখনো আমার নাম নাও না—
তবু আমি জানি,
রাতের অভিশার শেষে তোমার গ্লাসে যে জল থাকে,
তা আমি নিজ হাতে ঢেলে দিই—
ভালোবাসা তো জলেই দ্রবীভূত হয় সবচেয়ে গভীরভাবে।
হে দেহহীন প্রেম,
তুমি কি কখনো জেনেছো
ভালোবাসা কিভাবে ছায়া হয়ে থাকে?
মৃত্যুরও পরে?
তুমি ঘুমাও, আর আমি জেগে থাকি—
তোমার স্বপ্নে পাহারাদার হয়ে।
তোমার হাসির কণ্ঠস্বর
এখনো আমার কবরের কঙ্কালে ধ্বনিত হয়
এক বিষণ্ণ বাঁশির মতো।
এখন,
আমি কারো নাম বলি না—
শুধু এক শূন্য কণ্ঠে ফিসফিস করে বলি:
“ভালোবাসা কখনো মরে না—
তবু তুমিই আমার কবরের পাথরে লিখে গেলে মৃত্যুর তারিখ!”
✧ যেখানে আয়নাও চেনে না আমাকে ✧
একদিন আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম
তোমার দেয়া শেষ পাঞ্জাবিটা পরে—
আর আয়না অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,
“তুমি কে?”
আমি চুপ করেছিলাম।
ভাঙা কণ্ঠে বলিনি—
“আমি সেই, যাকে তুমি একদিন
ভালোবাসা বলে ঠোঁটে তুলে নিয়েছিলে।”
আয়নার গায়ে ফেলে রাখা
এক ফোঁটা কাঁচা আলো কেঁদে ফেলল—
তাতে দেখা গেল না আর মুখ,
শুধু ছায়ার কঙ্কাল।
হে বিশ্বাসঘাতী প্রেম,
তুমি এতটাই রূপ বদলে দিয়েছো আমাকে,
যে আমার ছায়াও আজ কাঁপে—
সে ভাবে, “এটা কি সত্যিই আমি?”
আমি হেঁটেছি এক শহরে
যেখানে বাড়িগুলো নিজেরাই কাঁদে,
আর বৈদ্যুতিক খুঁটিতে ঝোলে পুরনো দুঃস্বপ্ন।
সেখানে গিয়েও আমি নিজেকে পাইনি—
তুমি রেখে গেছো আমাকে এমন এক ভিন্ন জগতে,
যেখানে প্রেম মানে জাদুবিহীন যন্ত্রণা।
তুমি এখনো আয়নায় তাকাও—
কিন্তু তুমি যে মুখ দেখো,
সেটি কি আসলেই তোমার?
না কি সে মুখে আমার ছায়া লেগে আছে,
মিশে আছে অভিশাপের মতো?
একদিন তুমি হয়তো আয়নার সামনে দাঁড়াবে,
দেখবে—
তোমার ঠোঁটের নিচে অচেনা এক চিহ্ন,
তোমার চোখের কোনে এক পুড়ে যাওয়া স্বপ্ন।
তখন বুঝবে,
ভালোবাসা শুধু ফেলে আসা মুখ নয়,
ভালোবাসা মানে এক অদৃশ্য আত্মা—
যে আয়নাতেও দেখা যায় না,
তবু ফেলে যেতে পারে চিরন্তন ছায়া।
✧ ভালোবাসার গোরস্তান ✧
আমি হাঁটছিলাম এক গোরস্তানে—
কিন্তু এখানে কেউ সত্যিকারের মরেনি।
প্রতিটি কবরের ফলকে লেখা ছিল
তোমার নামের ভাঙা অক্ষর,
আমার কণ্ঠের নিঃশেষ ধ্বনি।
এটা এক মৃত ভালোবাসার নগর—
যেখানে কবরে ফুল নয়,
রাখা হয় পুরনো চিঠি,
ভাঙা চুড়ি, রক্তাক্ত হৃদয়
আর দুঃস্বপ্নে ফিরে আসা হাসির ছায়া।
একটি কবরের গায়ে লেখা ছিল:
“এখানে শুয়ে আছে সে,
যে শেষবার কেঁদেছিল
প্রিয়ার হাত বদলের পর।”
আরেকটি কবরের মাটি এখনো কাঁপছে—
তুমি কি জানো কেন?
কারণ সেই ভালোবাসা এখনো মরেনি,
এখনো প্রতি রাতে
এক মৃত পুরুষ জেগে উঠে,
প্রেমিকার নাম জপে,
পরে আবার আত্মহত্যা করে।
আমি কবরে বসে আছি—
নিজের গা দিয়ে ছায়া মুছে ফেলছি,
নিজের হৃদয়ের উপর বসানো ফলকে লিখছি—
“ভালোবাসা ছিল এক মহামারী—
যা আমাকে জীবিত রেখে শেষ করে দিয়েছে।”
পাশের কবর থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে এল—
“তুমি কি তাকে এখনো ভালোবাসো?”
আমি কিছু বলিনি,
শুধু চোখ বুজে দেখলাম—
তুমি এখনো একটা অন্য পুরুষের বাহুতে হাসছো,
কিন্তু সেই হাসির নিচে আমার একটা মৃত্যু চাপা পড়ে আছে।
এই গোরস্তান ভেঙে যাবে না কোনোদিন—
কারণ প্রতিটি মানুষ একদিন এখানে এসে
নিজের প্রেমকেই কবর দেবে।
এই কবরে শুয়ে থাকবে
অবহেলার কবিতা,
ভাঙা প্রতিশ্রুতি,
আর এমন সব চুম্বন—
যা কেবল বিদায় জানাতেই ব্যবহৃত হয়েছিল।
এবং যখন শেষবার সূর্য অস্ত যাবে—
তুমি একা দাঁড়িয়ে থাকবে আয়নার সামনে,
নিজেকেই চিনতে পারবে না,
কারণ ভালোবাসা শুধু আমাকে নয়,
তোমাকেও হত্যা করেছে—
অসাধারন সব প্রতারণার বিষে।
✧ আমি যদি আবার জন্মাই… ✧
(পরাবাস্তববাদী উপসংহার-কবিতা)
আমি যদি আবার জন্মাই—
তবে আমি রোদ হতে চাই না,
যে তোমার মুখ ছুঁয়ে আলোকিত হয়।
আমি হতে চাই এক অন্ধ গুহা,
যেখানে আলো ঢুকতে ভয় পায়,
আর তুমি হারিয়ে যাও নিজের ছায়ার মধ্যেই।
আমি যদি আবার জন্মাই—
আমি প্রেম করব না,
আমি ছায়া হব,
একটি নীরব বাতাস—
যা তোমার চোখে এসে ধুলো ঢেলে দেবে,
তুমি কখনোই আর দেখাতে পারবে না
ভালোবাসার মিথ্যে মুখোশ।
আমি যদি আবার জন্মাই—
তবে আমি নদী হব না,
যে তোমার পদক্ষেপে মোহিত হয়ে
চুপিচুপি দিক হারায়।
আমি হব মরুভূমি—
যেখানে তুমি পিপাসায় কাঁদবে,
আর আমি বলব,
“এসো, আমি জল।”
আমি যদি আবার জন্মাই—
আমি আমার নাম রাখব অভিশাপ,
তাতে থাকবে না কোনো ব্যঞ্জনবর্ণ,
শুধু এক দীর্ঘশ্বাসের মতো ব্যাকরণহীন শব্দ—
যেটি তুমি উচ্চারণ করলে
তোমার ঠোঁটেই আগুন ধরে যাবে।
আমি যদি আবার জন্মাই—
আমি এক কবিতা লিখব না তোমাকে নিয়ে,
আমি লিখব এক রুঢ় ইতিহাস,
যেখানে তুমি থাকবে না চরিত্র,
থাকবে শুধু এক ‘যদি’—
যা কেউ আর কখনও জানতে চাইবে না।
আমি যদি আবার জন্মাই—
তোমার মতো কাউকে চিনবো না,
ভালোবাসবো না, ক্ষমা করবো না।
আমি শুধু হাঁটবো—
আমার ছায়ার সঙ্গী হয়ে,
আর বলবো নিজেকে:
“তুই ধ্বংসের সন্তান, কিন্তু তোর চোখে এখনো আগুন আছে—
আর কাউকে জ্বালিয়ে ফেলিস না.