১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক অভিজাতরা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।
২১ মার্চ থেকে ঢাকায় ইয়াহিয়া খান, জুলফিকার আলী ভুট্টো ও বঙ্গবন্ধুর মধ্যে আলোচনা চলছিল, তবে এটি ছিল পাকিস্তানিদের জন্য সময়ক্ষেপণের কৌশল। ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন, আর রাতের আঁধারে শুরু হয় পরিকল্পিত সামরিক অভিযান—অপারেশন সার্চলাইট।
২৫ মার্চ রাত ১১টার পর পাকিস্তানি বাহিনী ট্যাংক ও ভারী অস্ত্রসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে হামলা চালায়। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, রাজাবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা (ইপিআর সদর দফতর), পুরান ঢাকা, নবাবপুর, সদরঘাট, সদর রোড, ধানমন্ডি ও রাজারবাগ ছিল প্রধান হামলার লক্ষ্য।
রাজাবাগ পুলিশ লাইনে ছিল বাংলাদেশ পুলিশের সাহসী প্রতিরোধ। অস্ত্রসজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর সামনে সাধারণ পুলিশের প্রতিরোধ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, তবে তারা বীরত্বের পরিচয় দিয়ে ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল), জগন্নাথ হল ও রোকেয়া হল ছিল প্রধান হামলার লক্ষ্য। ছাত্রদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মচারীদেরও হত্যা করা হয়। জগন্নাথ হলে থাকা বহু হিন্দু ছাত্রকে হত্যা করা হয়। অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেবসহ অনেক শিক্ষাবিদকে হত্যা করা হয়।
পিলখানায় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) সদস্যরা প্রতিরোধ গড়ে তুললেও পাকিস্তানি বাহিনীর ভারী অস্ত্রের সামনে টিকে থাকতে পারেননি। পুরান ঢাকায় বিভিন্ন বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়, মানুষকে হত্যা করা হয় নির্বিচারে।
সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয় নির্মমভাবে। নারী, শিশু, বৃদ্ধ—কেউ রেহাই পায়নি। যারা প্রাণে বাঁচতে চেয়েছিলেন, তারা দলে দলে বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে কেরানীগঞ্জের দিকে ছুটে যান। ঢাকা থেকে বের হওয়ার জন্য মানুষ দ্বিগবিদিক ছোটাছুটি করছিলেন।
২৫ মার্চ রাতের হামলায় আনুমানিক ৭,০০০ থেকে ১০,০০০ মানুষ নিহত হয়। বিশ্ব ইতিহাসে এটি অন্যতম বর্বর সামরিক অভিযানের উদাহরণ। এই গণহত্যার প্রতিবাদে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, যা মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনা করে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও স্বীকৃতি
২৫ মার্চ কালরাত্রি শুধু ইতিহাসের একটি তারিখ নয়; এটি বাঙালির রক্তাক্ত আত্মত্যাগের এক নির্মম দলিল। এই রাতের শহীদদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার পথকে সুগম করেছিল। আজকের প্রজন্মের উচিত এই ইতিহাস জানা, লালন করা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এর গুরুত্ব বুঝিয়ে দেওয়া, যাতে আর কখনো এমন বর্বরতা আমাদের ইতিহাসে পুনরাবৃত্তি না ঘটে।