এম এ বার্ণিক: বিশ্বসভ্যতার সবচেয়ে বড় সফলময় ও কল্যাণকর দিকটির পরিস্ফুটন ঘটেছে কেবলমাত্র জগতের সর্বোত্তম আদর্শ ও পূর্ণতম মানব হযরত মুহাম্মদ [স.]-এর আগমনের মাধ্যমেই এবং আজকের বৈজ্ঞানিক যুগেও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের নিরীক্ষণে তা আরও স্পষ্টতর হয়েছে। বিজ্ঞানের যতই অগ্রযাত্রা সূচিত হবে মহানবী [স.] ও আল-কোরআনকে মানুষ ততই বেশিভাবে বুঝতে কিংবা অনুধাবন করতে সক্ষম হবে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য সত্য যে, বৈজ্ঞানিক বিষয়াদির সমস্যা সমাধানকল্পে পৃথিবীতে তাঁর আগমন ঘটেনি; তিনি এসেছিলেন মানবজাতির চলার নিমিত্ত আল্লাহ্ প্রদত্ত একটি সুন্দর সাবলীল পথের দিশা নিয়ে এবং সেই পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থার বিভিন্ন বিষয়াদি উপস্থাপনের প্রেক্ষিত আল্লাহর বাণী তথা আল-কোরআনে এবং মহানবী [স.]-এর বাণী তথা আল-হাদীসে নানা বিষয়াদি বৈজ্ঞানিক সত্য উদ্ঘাটিত হয়েছে।
প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে যেসব বিষয়াদি উল্লেখপূর্বক বিজ্ঞানের গবেষণার প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছিল, আজকের যুগে সেসবের অনেক কিছুরই উদ্ঘাটন হয়েছে। এমনি-তর একটি বিষয় হচ্ছে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিজ্ঞান।
আল-কোরআন ও আল-হাদীসে রোগ-শোক, জরা-ব্যাধি, স্বাস্থ্য-ঔষধ সম্পর্কে যেসব উল্লেখ পাওয়া যায়, সেগুলো বিশ্ববাসীদের জন্য অনুসন্ধিৎসু হওয়ারই নিদর্শন বলা যেতে পারে।
যেহেতু মহানবী [স.] পরিপূর্ণ মানুষ এবং সকল ক্ষেত্রেই উত্তম আদর্শ হয়ে পদাচরণ করেছেন, সেহেতু এ দিকটিও তৎকর্তৃক কমবেশি আলোড়িত হয়েছে। যদিও মহানবী [স.] কোনো ‘থিওরি’ আকারে এগুলো উপস্থাপন করেননি, তথাপি স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাবিদ্যায় যেসব মূলনীতি এ পর্যন্ত অনুসৃত হচ্ছে, সেসবের প্রায়গুলোই নানাভাবে জগৎবাসীকে তিনি সে সময়েই জানিয়েছিলেন। মহানবী [স.]-এর একটি হাদীস, জ্ঞান দুই প্রকার- ধর্মের জ্ঞান ও শরীর সংক্রান্ত জ্ঞান এবং এ হাদীসটি উল্লেখপূর্বক Prof. Browne যে মন্তব্য করেছেন প্রসঙ্গত তা প্রণিধানযোগ্য : `Muhammad in a Traditions familiar to all Muslims is said to have linked medicine in importance with theology'- [Arabian Medicine সম্ভবত: এ জন্যই মুসলমানগণ জ্ঞানচর্চায় ব্রতী হয়েছিল।
আল-কোরআন ও আল-হাদীসে রোগ-শোক, জরা-ব্যাধি, স্বাস্থ্য-ঔষধ সম্পর্কে যেসব উল্লেখ পাওয়া যায়, সেগুলো বিশ্ববাসীদের জন্য অনুসন্ধিৎসু হওয়ারই নিদর্শন বলা যেতে পারে। আল-কোরআনে বিজ্ঞান সংক্রান্ত অন্যূন ১০৫০টি আয়াত রয়েছে এবং Medical Science-এর বিষয়ে এসবের মধ্যে ৩৫৫টি ও ঈযবসরংঃৎু সংক্রান্ত ৪৩টি। জার্মান পণ্ডিত Dr. Karl Opitz তাঁর Die Medizin Im Koran গ্রন্থে কোরআনের ১৪৪টি সূরার মধ্যে ৯৭টি সূরার ৩৫৫টি আয়াত চিকিৎসা বিজ্ঞানের সহিত সংশ্লিষ্ট বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি কোরআনের এ চিকিৎসা সম্বন্ধীয় অনুজ্ঞাকে তিন ভাগে ভাগ করে আলোচনা করেন :-
১। গবফরুরহ বা চিকিৎসা সংক্রান্ত :-
(i) জীবন রহস্য-সৃষ্টি, ভ্রূণ, গর্ভাধান, গর্ভাবস্থা, শিশু পরিচর্যা, শৈশবাবস্থা, আয়ুষ্কাল।
(ii) শারীরস্থান (Anatomy) ও শারীরবৃত্ত (Physiology)।
(iii) রোগ নিরূপণ বিদ্যা (Pathology), নিদানবিদ্যা (Etiology), মনস্তত্ত্ব (Psychology), মনন নিদান (Psycho-pathology)।
(iv) চিকিৎসা- সাধারণ চিকিৎসা, বিশেষ চিকিৎসা।
(v) মৃত্যু ও পুনর্জীবন।
২। Hygiene বা স্বাস্থ্যবিদ্যা :-
(i) ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি- পোশাক-পরিচ্ছদ, বিশ্রাম, শরীরের যত্ন, পুষ্টি ও পানীয়।
(ii) সামাজিক স্বাস্থ্যবিধি- ঘরবাড়ির পরিচ্ছন্নতা, সংক্রামক ব্যাধি।
(iii) আকস্মিক দুর্ঘটনা, মহামারি।
৩। Gesundheitsgestez বা স্বাস্থ্য-বিধান
(i) শারীরিক পরিপুষ্টিগত- মাংস, মেদ ইত্যাদি বিষয়ক।
(ii) যৌন বিধিবিধান- সুষ্ঠু ও অসুষ্ঠু যৌন ক্রিয়া।
(iii) আনুষ্ঠানিক বিধিবিধান- ত্বকচ্ছেদ, রোজা, নামাজ, অজু, গোসল।
(iv) সামাজিক বিধিবিধান- হত্যা, প্রতিশোধ, অভিভাবকত্ব।
স্বাভাবিক দৃষ্টিকোণ থেকে লক্ষ্য করলে দেখা যাচ্ছে যে, প্রত্যেক হাদীস গ্রন্থেও চিকিৎসা সংক্রান্ত দু-একটি পরিচ্ছেদ রয়েছে।
প্রসঙ্গত বোখারী শরীফের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এটির চতুর্থ খণ্ডের দুটো পরিচ্ছেদে ৮০টি বাব বা অধ্যায়ে ঔষধ ও পীড়িতদের সেবা শুশ্রূষার বিষয়ে নানা প্রকার নির্দেশ লক্ষ্য করা যায়। এ প্রসঙ্গে E. G. Browne বলেন, ‘If we take the Sahih of Al-Bukhari, the most celebrated of those collections, we find at the beginning of the fourth
volume two books dealing with medicine and the sick, containing in all so chapters. This looks promising but when we come to examine them more closely, we find that only a small portion deal with medicine, surgery or therapeutics as we understand them and the visitation, encouragement and spiritual consolation of the sick, the evil eye, magic, talismans, amulets and protective prayers and formulae.’ - [Arabian Medicine] যাই হোক, মহানবী [স.]-এর সেসব উপদেশাবলি পরবর্তীকালে তিব্বুন্ নবী বা নবীর চিকিৎসা নামে গ্রন্থাকারে বিভিন্ন প্রকাশকগণ প্রকাশ করেছেন। সপ্তদশ শতাব্দীতে এ জাতীয় অর্ধ-ডজন খানেক পুস্তক বাজারে পাওয়া যেত। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এসব বই সাড়া জাগাতে না পারলেও, ধর্মপ্রাণ লোকদের নিকট এগুলো সমাদৃত হত।
মহানবী [স.] পৃথিবীতে প্রথম ব্যক্তি যিনি মানবজাতিকে সকল রোগের চিকিৎসা সম্ভব বলে আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি ঘোষণ করেন, ‘আল্লাহ্ এমন কোনো রোগ দেন নাই, যার কোনো ঔষধ নেই’- বোখারী, কিতাবুত্ তিব্। যুগ যুগ ধরে অনুসন্ধিৎসু মানব মনকে এ হাদীসটি রোগ নিরাময়ের উপায় উদ্ভাবনে অনুপ্রেরণা যোগাতে থাকবে।
ছোঁয়াছে রোগ অর্থাৎ রোগীকে স্পর্শ করলেই রোগাক্রান্ত হতে হবেÑ এমনটা তিনি স্বীকার করতেন না। তবে সংক্রামক ব্যাধি রয়েছে বলে মনে করতেন। তিনি বলেছেন, ‘ছোঁয়াছে ব্যাধি নেই, সংক্রামক রোগ আছে, অশুভ লক্ষণ অমঙ্গলের চিহ্ন বলতে কিছু নেই, পেঁচা সম্পর্কে অশুভ লক্ষণের ধারণাতে কোনো বাস্তবতা নেই এবং সফর মাসকে অশুভ মনে করারও কোনো ভিত্তি নেই। তবে কুষ্ঠরোগী থেকে এমনভাবে দূরে সরে যাও যেমনটা মানুষ ব্যাঘ্র থেকে দূরে থাকে’- বোখারী, কিতাবুত্ তিব্। সংক্রামক রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে তিনি বহির্গত হতে নিষেধ করতেন।
কলেরা, বসন্ত প্রভৃতি মহামারি বা প্লেগ রোগ থেকে সতর্ক থাকার জন্য তিনি উপদেশ দিতেন। তিনি বলেন, ‘যখন তোমরা শুনতে পাও কোথাও প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে, সেখানে যেও না। আর তোমরা যেখানে আছো সেখানে এমনি মহামারি দেখা দিলে তোমরা সে স্থানটা ত্যাগ করবে না’- [বোখারী]
রোগ নিরাময়ের জন্য তিনি তিনটি জিনিসের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন এবং সেগুলো হচ্ছে- মধু পান, সিঙ্গা লাগানো ও গরম লোহা দ্বারা দাগানো- [বোখারী]
‘মধুতে রোগের নিরাময় নিহিত রয়েছে’- মহানবী [স.]-এর এমন একটি বাণী বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে দেখা যায়। আল-কোরআনেও মহান আল্লাহ্ মধুকে রোগারোগ্যের প্রতিষেধক হিসেবে উল্লেখ করে চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। [সূরা নাহল, আয়াত-৬৯]
উক্ত আয়াতের বিষয় উল্লেখ করতে গিয়ে Dr. Hartwig Herschfeld মনে করেন, ‘In the same way the Quran gave an impetus to medical studies (such as verse 69 of the 16th sura Nahl), where honey is
mentioned as a medicine and recommended the contemplation and study of Nature general’- New Researches into the composition and Exegesis of the Quran.
মহানবী [স.] ‘জাহান্নামের আগুন থেকে জ্বরের উৎপত্তি’ বলে অভিহিত করে জ্বরকে পানি দ্বারা ঠাণ্ডা করতে তিনি উপদেশ দেন [বোখারী]
আধুনিক ডাক্তারি বিজ্ঞানেও এ বিষয়টির উপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। জাহান্নামের আগুন থেকে জ্বর আসছে কিনা এ নিয়ে তাদের মাথা ঘামানি না থাকলেও, জ্বরের সময় মাথায় পানি দেয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এই যে জ্বরের সময় মাথায় পানি দেয়া কিংবা আইস-ব্যাগ লাগিয়ে তাপ নিবারণ করার ডাক্তারি বিধান, এ হাদীসটিরই উপর ভিত্তি করে হয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না।
নানা রোগের জন্য নানা ঔষধ ব্যবহারের যেসব তথ্য হাদীস গ্রন্থসমূহে পাওয়া যায়, তা থেকে আলোচনার জন্য এখানে কয়েকটি উপস্থাপন করছি :-
নবীজী বলেছেন, “ব্যাঙের ছাতা ‘মান্ন’ থেকে হয় এবং এর রস চোখের জন্য ঔষধ বিশেষ [বোখারী] কিংবা শামুক মান্না জাতীয় এবং ইহার রস চক্ষু রোগের মহৌষধ” [তিরমিজী]
কেটে গেলে ক্ষতস্থানে মেহেদির প্রলেপ দেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, ‘যদি হঠাৎ কিছু কেটে যায় কিংবা থেতলিয়ে যায়, তবে সেখানে মেহেদির প্রলেপ দিলে দ্রুত আরোগ্য হবে”- তিরমিজী
ব্যথা-বেদনার জন্য তিনি সাধারণত ভারতীয় উদ্ভিদ ব্যবহারের কথা বলতেন; বোখারী শরীফে হাদীসটি কয়েকবারই উদ্ধৃত হয়েছে। এছাড়া ইব্ন মাজা হাদীস গ্রন্থে বেদনার জন্য লবণের ব্যবহারের উপদেশ রয়েছে।
তালবিনা এক ধরনের লঘুপাক খাদ্য। এটা আটা, মধু ও পানির সংমিশ্রণে তৈরি করা হত। এ তালবিনার গুণাগুণ সম্পর্কে হযরত [স.]-এর বাণী, ‘তালবিনা রোগীর প্রাণে শক্তি সঞ্চার করে- কর্মক্ষমতা দান করে এবং দুশ্চিন্তা দূর করে’। [বোখারী]
কালজিরাকে নবীজী সকল রোগের অব্যর্থ মনে করতেন; তিনি বলেন, ‘কালজিরার মধ্যে একমাত্র মৃত্যু ব্যতীত সকল রোগের চিকিৎসা নিহিত’। [বোখারী]
স্বাস্থ্য রক্ষার্থে এবং রোগবালাই থেকে মুক্ত থাকার জন্য মহানবী [স.] যেসব উপদেশ দান করেছেন তা পৃথিবীতে অন্য কোনো বৈজ্ঞানিক কিংবা ডাক্তার এতো ব্যাপকভাবে দিতে পেরেছেন বলে আমাদের জানা নেই। তিনি খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শরীর, আসবাবপত্র, জুতা-জামা ও পানি পরিচ্ছন্ন ও নির্মল রাখার জন্য বহু উপদেশ বাণী রেখে গিয়েছেন। উল্লেখ্য, কোরআনে স্বাস্থ্যবিধি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পান-আহার সম্পর্কে যেসব অনুজ্ঞা দেখা যায়, রাসূলে করিম [স.]-এর উপদেশাবলি (কাওলি হাদীস) ছাড়াও বহু ব্যবহারিক কার্যাবলিতে (ফেলি হাদীস) উপহার প্রতিফলন দেখা যায়। (চলবে)
Get high-quality digital marketing services at an affordable price with Scrollbd. We believe in providing our clients with cost-effective solutions that deliver results.
<p>সম্পাদক ও প্রকাশক: লিটন হোসাইন জিহাদ</p>
© PothikTV Media Center