ছাতিমের ঘ্রাণমাখা রাত

আকাশে ঝলমলে সূর্য, দিগন্তজোড়া সাদা মেঘের আনাগোনায় অপূর্ব নীলের চিত্র লিপিতে আঁকা এখনকার প্রকৃতি। ক্যালেন্ডারের পাতায় শারদীয় দিন পেরিয়ে এসেছে হেমন্ত। ঋতুর পালাবদলে দুঃসহ উত্তাপ থেকে মিলছে একটু স্বস্তি, পল্লিগ্রামে সন্ধ্যারাতে পাওয়া যাচ্ছে কিছুটা শীতল আমেজ।

 

হেমন্তের স্নিগ্ধ প্রকৃতিতে সন্ধ্যা নামতেই নাকে লাগে দূর থেকে ভেসে আসা ফুলের গন্ধ। চারপাশের বাতাস মাতাল করা এমন সুবাস কিছুতেই উপেক্ষা করা যায় না।  রাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যেন বাড়তে থাকে সৌরভের মাত্রা।

 

হেমন্তের রাতে হৃদয় আকুল করা সুবাস ছড়ানো এ ফুলের নাম ছাতিম। পাড়াগাঁয়ে শৈশব-কৈশোর কাটানো অনেকেরই জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এমন গন্ধমাখা বহু রাতের স্মৃতি। আমারও তার ব্যতিক্রম নয়।

 

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘পথের পাঁচালী’র অপু ও দুর্গার মতো ছোটবেলায় এর সুরভিতে মুগ্ধ হলেও ফুলের নামটি জেনেছি বহু পরে। আমার শৈশবের সেই ছাতিমগাছটি এখন নেই, পথপাশে বেড়ে ওঠা বয়সী গাছটি আগেই কাটা পড়েছে। তবু মনে উজ্জ্বল হয়ে জেগে আছে সেসব দিনের বর্ণিল স্মৃতি।

 

এখনো গ্রাম-শহর সর্বত্র ভালোভাবেই টিকে আছে ছাতিম গাছ। বনবাদাড়ে, লোকালয়ে এটি নিজে থেকেই বেড়ে ওঠে। নগরের বাগানেও সাদরে জায়গা পেয়েছে এই বৃক্ষ। শরতের শেষ থেকে হেমন্তজুড়ে গাছভরে থোকায় থোকায় ফুলে ফোটে। ফুল ছোট, তেমন উজ্জ্বল নয়। শাখায় শাখায় সাদা-সবুজাভ রঙে গুচ্ছে গুচ্ছে ফোটে বলে নজর এড়ায় না। অবশ্য ছাতিমের গন্ধ সবারই প্রিয় এমন নয়, উগ্র, কড়া বলে কারও কাছে এটা অপছন্দনীয়।

 

ছাতিমের পাতাও বেশ দৃষ্টিনন্দন, ডালের আগায় একসঙ্গে ছয়-সাতটি পাতা মিলে অপূর্ব সুন্দর বিন্যাসে নিজেকে প্রকাশ করে। তাই ছাতিমের আরেক নাম সপ্তপর্ণ। পাতাগুলো গাছজুড়ে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত ছাতার মতো থরে থরে সাজানো। ফুলের বিপুল ঐশ্বর্যে, পাতার সুনিবিড় ছায়ায় সুউচ্চ ছাতিম তীব্রভাবে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করে। কথাসাহিত্যিক বিপ্রদাশ বড়ুয়ার মতে, ‘হেমন্ত ও শীতের শূন্যতায় ছাতিম প্রবল প্রাণের প্রতীক।’

 

ছাতিমের বৈজ্ঞানিক নাম Alstonia scholaris। পড়ালেখার সঙ্গে যোগ আছে বলে দ্বিতীয় অংশের এমন নামকরণ। একসময় এর কাঠ দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ড ও ছাত্রদের লেখার শ্লেট তৈরি করা হতো। ছাতিমগাছ নিয়ে আছে নানা উপকথা ও কিংবদন্তি।

 

বিভিন্ন অঞ্চলে আদিবাসীরা এর তলায় বসতে বা এর ছায়া মাড়াতে চায় না। ছাতিমগাছের সঙ্গে শয়তানের যোগসূত্র আছে বলে অনেকের বিশ্বাস; তাই ইংরেজি নাম ডেভিলস ট্রি। আমাদের পুষ্পরাজ্যে হেমন্তের উজ্জ্বল প্রতিনিধি ছাতিম রাজধানীতেও সহজলভ্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Notice: ob_end_flush(): Failed to send buffer of zlib output compression (0) in /home/pothiknews/public_html/wp-includes/functions.php on line 5309