আর্ন্তজাতিক ডেক্স
পিয়ংইয়ং থেকে রওয়ানা করার আগে মি. কিম তার সাঁজোয়া যান থেকে হাত নাড়ান।
উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং আন তার ব্যক্তিগত ট্রেনে করে মঙ্গলবার সকালে রাশিয়ায় প্রবেশ করেছেন বলে এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক বাহিনী।
রাশিয়ার এক সরকারি কর্মকর্তার বরাত দিয়ে জাপানের মিডিয়া আউটলেট জেএনএন জানিয়েছে, কিম জং আন রাশিয়ার খাসান সীমান্ত স্টেশনে পৌঁছেছেন।
প্রাইমরস্কি ক্রাই এলাকায় অবস্থিত স্টেশনটিতে উত্তর কোরিয়ার নেতাকে স্বাগত জানিয়ে একটি অনুষ্ঠান করা হয়েছে।
বিবিসির বিশ্লেষক যিনি ট্রেনের বিষয়ে নজর রাখছেন তার মতে, খাসান থেকে ভ্লাদিভোস্তকে পৌঁছাতে আরো পাঁচ-ছয় ঘণ্টার মতো সময় লাগবে।
প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে একটি বৈঠকে যোগ দিতে তিনি রাশিয়া সফরে গিয়েছেন বলে এর আগে জানানো হয়।
এক মার্কিন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রাশিয়া ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণের মুখে পড়ার কারণে এই দুই নেতা অস্ত্র চুক্তি নিয়ে আলোচনা করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম কেসিএনএ এর প্রতিবেদনে জানানো হয়, মি. কিমের সাথে সফরসঙ্গী হিসেবে সরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা এবং সামরিক কর্মকর্তারা রয়েছেন।
রাশিয়ায় তার সফরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে ক্রেমলিনও। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার সকালে দুই নেতার মধ্যে বৈঠক শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, পিয়ংইয়ং থেকে রওয়ানা করার আগে মি. কিম তার সাঁজোয়া যান থেকে হাত নাড়ছেন।
বিবিসি’র মার্কিন সহযোগী সিবিএস নিউজ এর খবরে বলা হয়, পেন্টাগন জানিয়েছে, ‘কোন একটি বৈঠকে অংশ নিতে’ মি. কিম রাশিয়ায় যাচ্ছেন বলে তারা মনে করে।
যদি মি. পুতিনের সাথে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় তাহলে গত চার বছরের মধ্যে এবং মহামারির পর থেকে এটা হবে উত্তর কোরিয় নেতার প্রথম আন্তর্জাতিক সফর।
সিবিসি-কে এর আগে এক মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, বৈঠকের আলোচ্যসূচির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ইউক্রেনের সাথে যুদ্ধে মস্কোকে উত্তর কোরিয়ার অস্ত্র সরবরাহ করার বিষয়টি।
মি. কিমের সবশেষ সফরটিও ছিল ২০১৯ সালে ভ্লাদিভোস্তকে। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে পারমানবিক অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণ আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার পর মি. পুতিনের সাথে এক বৈঠকে যোগ দিতে সেখানে গিয়েছিলেন তিনি।
তার সাঁজোয়া ট্রেনটিতে কমপক্ষে ২০টি বুলেট প্রুফ গাড়ি রয়েছে যা ট্রেনটিকে সাধারণ ট্রেনের তুলনায় অনেক বেশী ভারী করেছে এবং এ কারণেই এটি ঘণ্টায় ৫৯ কিলোমিটারের বেশি বেগে চলতে পারবে না। ভ্লাদিভোস্তকে পৌঁছাতে তার পুরো দিন লেগে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
হোয়াইট হাউস বলেছে, রাশিয়া এবং উত্তর কোরিয়ার মধ্যে অস্ত্র সহযোগীতার বিষয়টি “সক্রিয়ভাবে এগিয়ে চলেছে” বলে তাদের কাছে নতুন তথ্য রয়েছে।
এরআগে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের মুখপাত্র জন কিরবি বলেন, রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু উত্তর কোরিয়ার তার সাম্প্রতিক সফরের সময় রাশিয়ার কাছে ‘পিয়ংইয়ংকে আর্টিলারি গোলাবারুদ বিক্রিতে রাজি করাতে’ চেষ্টা করেছেন।
ওয়াশিংটন ভিত্তিক থিংক ট্যাংক কার্নেগি এনডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সদস্য অঙ্কিত পান্ডে বলেন, রাশিয়া এবং উত্তর কোরিয়া প্রত্যেকের এমন কিছু জিনিসপত্র রয়েছে যা অন্যান্য দেশও চায়।
তিনি বলেন, “এখন যেটি দেখার বিষয় হবে সেটি হচ্ছে পরস্পরকে সহযোগীতা করতে তারা নিজেদের সুবিধাজনক কোন মূল্য খুঁজে পায় কিনা।”
রাশিয়া হয়তো উত্তর কোরিয়ার কাছে খাবার এবং কাঁচামালের বিনিময়ে আর্টিলারি শেল এবং রকেট আর্টিলারির মতো প্রচলিত যুদ্ধাস্ত্রই চাইবে। একই সাথে তারা জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে উত্তর কোরিয়ার প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখবে।
“এর মাধ্যমে রাশিয়ায় উত্তর কোরিয়ার অত্যাধুনিক অস্ত্র-শস্ত্র স্থানান্তর করার সুযোগ তৈরি করে দিতে পারে যাতে করে মস্কো তার নিজের প্রচলিত অস্ত্রের মজুদ আবার পূরণ করে তা ধরে রাখতে পারে।”
ধারণা করা হয় যে, রাশিয়ার হয়তো ১২২এমএম এবং ১৫২এমএম কার্তুজ দরকার কারণ তাদের মজুদ শেষ হয়ে আসছে। কিন্তু গোপনীয়তার স্বভাবের কারণে উত্তর কোরিয়ার কাছে কী পরিমাণ অস্ত্র মজুদ রয়েছে তা অনুমান করা সহজ নয়।
মি. কিম এবং মি. শোইগুর মধ্যে বৈঠকের সময়ে যেসব অস্ত্র প্রদর্শন করা হয়েছিল তার মধ্যে রয়েছে হয়াসাং আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র যা দেশটির প্রথম আইসিবিএম অস্ত্র যাতে তরল বা গ্যাসের পরিবর্তে কঠিন জ্বালানি ব্যবহার করা হয়েছে।
সেটাই ছিল কোভিড মহামারির পর বিদেশি অতিথিদের জন্য উত্তর কোরিয়ার প্রথম দ্বার খোলার ঘটনা।
কিমের বুলেটপ্রুফ অভিজাত ট্রেনে যা আছে
প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে দেখা করতে একটি বুলেটপ্রুফ ট্রেনে করে রাশিয়ার বন্দর শহর ভ্লাদিভোস্তকে গিয়েছেন উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং আন।
উত্তর কোরিয়ার অন্য নেতাদের মতোই দেশটির দীর্ঘদিনের রীতি মেনে মি. কিম ২০ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে ১১৮০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেছে ধীর গতির ট্রেনে। যেখানে একটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে যাতে উৎকৃষ্ট মানের ফরাসি ওয়াইন এবং খাবার যেমন তাজা গলদা চিংড়ি দিয়ে তৈরি খাবারও পরিবেশন করা হয়।
ভারী সাঁজোয়া যান হওয়ার কারণে ট্রেনটি ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে চলতে পারবে না।
তুলনা হিসেবে বলা যায়, লন্ডনের উচ্চ-গতির রেলগুলো ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটার এবং জাপানের শিনকানসেন বুলেট ট্রেন ঘণ্টায় ৩২০ কিলোমিটার বেগে চলে।
উত্তর কোরিয়ার প্রাচীন রেল নেটওয়ার্কের কারণেও অনেক সময় যাত্রা দীর্ঘ হয়।
ট্রেনটির নামকরণ করা হয়েছে তাইয়াংহো যার অর্থ সূর্য্য এবং এর মাধ্যমে উত্তর কোরিয়ার প্রতিষ্ঠাতা কিম ইল সাংকেও প্রতীকিভাবে তুলে ধরা হয়।
দীর্ঘ সময় ধরে ট্রেন যাত্রার রীতি প্রথম শুরু করেন কিম জং আনের দাদা কিম ইল সাং। তিনি নিজের ট্রেনে করে ভিয়েতনাম এবং পশ্চিম ইউরোপের দেশে গিয়েছিলেন।
এই অভিজাত ট্রেনগুলো নিরাপত্তা এজেন্টরা কড়া পাহারা দিয়ে থাকে এবং তারা ট্রেনের যাত্রাপথ এবং সামনের স্টেশনে বোমা বা কোন হুমকির শঙ্কা আছে কিনা তা খতিয়ে দেখে।
কিম জং উনের বাবা কিম জং ইল যিনি ১৯৯৪ সাল থেকে শুরু করে ২০১১ সালে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত উত্তর কোরিয়া শাসন করেছেন, তিনিও ট্রেনে করে ভ্রমণ করতেন তার বিমানে ভয় থাকার কারণে।
এর আগে ২০০১ সালে মি. পুতিনের সাথে বৈঠক করতে মস্কোতে পৌঁছাতে ১০ দিন সময় লেগেছিল কিম জং ইলের।
রাশিয়ার সামরিক কমান্ডার কন্সট্যানটিন পুলিকোভস্কি যিনি উত্তর কোরিয়ার সাবেক নেতার সাথে ২০০১ সালে একই ট্রেনে ভ্রমণ করেছিলেন, তিনি তার স্মৃতিকথা ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসে লিখেছেন ট্রেনের আভিজাত্যের বিষয়ে।
“রাশিয়ান, চাইনিজ, কোরিয়ান, জাপানিজ এবং ফ্রেঞ্চ- যেকোন ধরণের খাবারের অর্ডার দেয়ার সুযোগ ছিল এই ট্রেনে।”
সূত্র: বিবিসি নিউজ বাংলা
নিউজ/ মো:ইমন