আখাউড়া ইমিগ্রেশনে ঘুষ বাণিজ্যের রাজত্ব, ঘুষ না দিলে ভারত যাত্রা বাতিল

লেখক: মোঃমনির হোসেন
প্রকাশ: ২ মাস আগে

আখাউড়া আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে ওসির নেতৃত্বে ঘুষ বাণিজ্য এবং ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে ভারতের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাওয়া মেডিকেল ভিসাধারী যাত্রীরা চরম হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

প্রতিদিন অসংখ্য যাত্রীর কাছ থেকে নানা অজুহাতে লাখ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়া হচ্ছে। যাত্রীদের অভিযোগ, ইমিগ্রেশনের ওসি, কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং দালালদের সমন্বয়ে একটি প্রভাবশালী চক্র গড়ে উঠেছে।

ভুক্তভোগীদের দাবি, মেডিকেল ভিসায় ভারতে যাওয়া যাত্রীদের কাছ থেকে ৫ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেওয়া হয়। টাকা না দিলে ‘ডকুমেন্টস ঠিক নেই’ বা ‘মেডিকেল কনফার্মেশন ঝুঁকিপূর্ণ’ ইত্যাদি অজুহাতে সীমান্ত পারাপার আটকে দেওয়া হয়।

সূত্র জানায়, প্রতিদিন গড়ে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ আদায় করে এই চক্রটি। পাসপোর্টে সিল মারা, ভিসা যাচাই এবং ছবি তোলার মতো প্রক্রিয়াতেও ব্যাপক অনিয়ম চলছে।

গোপন সূত্রে জানা গেছে, ভারতের আগরতলার বাসিন্দা নমিতা বণিক গত ১৪ এপ্রিল বাংলাদেশে আসেন। তার ভিসায় ৬০ দিনের বেশি বাংলাদেশে অবস্থানের অনুমতি না থাকলেও তিনি অতিরিক্ত ১ মাস ২০ দিন অবৈধভাবে ছিলেন।

ইমিগ্রেশনের ডাটায় দেখা যায়, ২ আগস্ট তিনি আবার আগরতলায় ফিরে যান। এ কাজটি করা হয় এসআই আব্দুর রহিমের আইডি ব্যবহার করে এবং এর জন্য ওসি মোহাম্মদ আব্দুস সাত্তার ও এসআই আব্দুর রহিম তার কাছ থেকে ৯৫ হাজার টাকা ঘুষ নেন।

গত ২২ জুলাই কুমিল্লার দাউদকান্দির দুই বাসিন্দা রুবেল মিয়াজি ও মোহাম্মদ ফেরদৌস চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়ার চেষ্টা করলে এসআই আবদুর রহিম তাদের কাছে ৪০ হাজার টাকা দাবি করেন। তারা রাজি না হলে তিনি ভারতীয় ইমিগ্রেশনে ফোন করে তাদের পাসপোর্ট নম্বর দেন। আগরতলায় পৌঁছে ভারতীয় ইমিগ্রেশন তাদের এন্ট্রি রিফিউজ করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠায়। পরে আখাউড়ায় ফিরে আসার পর পুনরায় টাকা দাবি করা হলে ৫ হাজার টাকা দিয়ে তারা ছাড় পান।

আরেক অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২৩ জুলাই সকাল ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে চারজন মেডিকেল ভিসাধারী যাত্রীর জন্য ৮০ হাজার টাকার রফাদফা হয়। কনস্টেবল দেলোয়ার হোসেন নিজেই তাদের পাসপোর্ট নিয়ে পুলিশের ব্যারাক রুমে গিয়ে এসআই আব্দুর রহিমের হাতে দেন এবং লাইনে না দাঁড়িয়েই তাদের পার করে দেওয়া হয়। যাত্রী ছাউনিতে বসে টাকা লেনদেনের মাধ্যমে পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করলে এসব অনিয়ম স্পষ্ট হবে।

কনস্টেবলের কাজ যাত্রীদের শৃঙ্খলা রক্ষা করা হলেও দেলোয়ার হোসেন তিন বছর ধরে নিয়মিত ইমিগ্রেশন ডেস্কে বসে কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। অভিযোগ রয়েছে, তিনি চোরাচালান চক্র ও ‘লাগেজ পার্টি’র সঙ্গে যোগসাজশে সুবিধা দিয়ে আসছেন। দেলোয়ার এবং ওসি আব্দুস সাত্তার দুজনই মুরাদনগরের বাসিন্দা হওয়ায় এই কর্মকাণ্ডে অভ্যন্তরীণ যোগসাজশের সুযোগ তৈরি হয়েছে।

এ ছাড়া, ভারত থেকে ফেরার সময় সিল ছাড়া বাংলাদেশে প্রবেশ করা যাত্রীদের কাছ থেকেও মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

গত ১৫ দিন পর্যবেক্ষণকালে দেখা গেছে, ওসি আব্দুস সাত্তারকে সকাল ৮টা থেকে ১১টার মধ্যে অফিসে পাওয়া যায়নি এবং তিনি প্রতিদিন বিকেল ৫টার আগেই অফিস ত্যাগ করেন। অথচ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কর্মস্থল ত্যাগের নিয়ম নেই। এসআই আব্দুর রহিম ও ওসি আব্দুস সাত্তার একসাথে আসা-যাওয়ারও অভিযোগ আছে।

এক ঘটনায়, ঢাকা কাস্টমস হাউস কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত এক যাত্রীকে দেলোয়ার মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ইমিগ্রেশন পার করিয়ে দেন। উপপরিদর্শক হাবিবের আইডি ব্যবহার করে ওই যাত্রীর পাসপোর্টে সিল দেওয়া হয়। পরে বেনাপোলে ধরা পড়লে বিষয়টি স্পেশাল ব্রাঞ্চ পর্যন্ত পৌঁছায়।

যাত্রীরা অভিযোগ করেন, আখাউড়া আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে প্রতিদিনের কার্যক্রমে চলমান অনিয়ম ও দুর্নীতি শুধু যাত্রীদের জন্য নয়, দেশের ভাবমূর্তির জন্যও ভয়াবহ বার্তা। তারা মনে করেন, ইমিগ্রেশন একটি আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট, তাই শুদ্ধি অভিযান ছাড়া এ চক্র বন্ধ করা সম্ভব নয়।

এ বিষয়ে আখাউড়া আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশনের ওসি মোহাম্মদ আব্দুস সাত্তার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমি যোগদানের পর থেকে সবকিছু নিয়ম অনুযায়ী হচ্ছে। কোনো যাত্রী হয়রানির শিকার হচ্ছেন না।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার এহতেশামুল হক বলেন, যাত্রী হয়রানি এবং ঘুষ নেওয়ার অভিযোগের বিষয়টি আমার জানা নেই। তদন্ত করে প্রমাণ পাওয়া গেলে দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।