সুদানে রক্তাক্ত মানবিক বিপর্যয় — আরএসএফ সংঘর্ষে ধ্বংস হচ্ছে এক জাতির ভবিষ্যৎ

লেখক:
প্রকাশ: ২ সপ্তাহ আগে
সুদানে রক্তাক্ত মানবিক বিপর্যয় — আরএসএফ সংঘর্ষে ধ্বংস হচ্ছে এক জাতির ভবিষ্যৎ

লিটন হোসাইন জিহাদ: আফ্রিকার পূর্বাঞ্চলের দেশ সুদান আজ এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রাজধানী খারতুম থেকে শুরু করে দারফুর পর্যন্ত আগুন, ধ্বংস আর মৃত্যু এখন প্রতিদিনের বাস্তবতা। দেশটিতে সরকারি সেনাবাহিনী (Sudanese Armed Forces – SAF) ও আধা-সামরিক বাহিনী Rapid Support Forces (RSF)–এর মধ্যে চলমান সংঘর্ষে হাজারো মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, লক্ষাধিক পরিবার গৃহহীন হয়েছে, আর অসংখ্য শিশু আজও ক্ষুধা ও আতঙ্কে কাঁদছে।

আরএসএফ বা Rapid Support Forces মূলত ২০০৩ সালের দারফুর যুদ্ধের সময়কার Janjaweed নামক এক মিলিশিয়া বাহিনী থেকে গঠিত। সেই সময় সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশির বিদ্রোহ দমনে এই মিলিশিয়াদের ব্যবহার করেন। তাদের উপর হত্যাযজ্ঞ, নারী নির্যাতন ও জাতিগত নিধনের অভিযোগ ওঠে।

২০১৩ সালে এই বাহিনীকে সরকারিভাবে পুনর্গঠন করে “Rapid Support Forces” নাম দেওয়া হয়। এর নেতৃত্বে আছেন মোহাম্মদ হামদান দাগালো (Mohamed Hamdan Dagalo), যিনি “হেমেদতি” নামে বেশি পরিচিত।

আনুষ্ঠানিকভাবে আরএসএফ সরকারের নিরাপত্তা কাঠামোর অংশ হলেও বাস্তবে তারা সেনাবাহিনীর বাইরে একটি স্বাধীন, সশস্ত্র শক্তিতে পরিণত হয়েছে। এই দুই বাহিনীর মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বই ২০২৩ সালে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়।

২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে শুরু হয় মূল সংঘর্ষ। সেনাবাহিনী ও আরএসএফ উভয়েই দেশটির ক্ষমতা দখলের চেষ্টা চালায়। সামরিক অভ্যুত্থানের পর সুদান যখন বেসামরিক সরকারের পথে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে এই দুই পক্ষের মধ্যে অবিশ্বাসের দেয়াল তৈরি হয়।

দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে রাজধানী খারতুম, ওমদুরমান, দারফুর, কর্ডোফান, এবং ব্লু নাইল অঞ্চলে।

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই বছরে সংঘর্ষে বারো হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, এক কোটিরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, এবং মিলিয়ন শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে।

বিশেষ করে দারফুর অঞ্চলে জাতিগত নিধনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

জাতিসংঘ মানবাধিকার অফিস (OHCHR) জানায়, আরএসএফ বাহিনী summary executions, গণহত্যা ও যৌন সহিংসতার মতো অপরাধে জড়িত।

একাধিক মানবাধিকার সংস্থা জানিয়েছে, নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী। খাদ্য, পানি ও চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর হার বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে।

যুক্তরাষ্ট্র ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেয় যে RSF দারফুরে গণহত্যা (genocide) ঘটিয়েছে। ফলে আরএসএফ নেতা হেমেদতির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।

জাতিসংঘ, আফ্রিকান ইউনিয়ন, ও আরব লীগ শান্তি আলোচনার আহ্বান জানালেও মাঠে বাস্তব কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না।

The Guardian ও Washington Post–এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আরএসএফ বাহিনী জাতিসংঘের খাদ্য সহায়তা কাফেলায় আক্রমণ, স্বাস্থ্যকর্মী হত্যা এবং শরণার্থী শিবিরে আগুন দেওয়ার মতো কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছে।

এই যুদ্ধ কেবল অস্ত্র ও রাজনীতির নয়—এটি মানবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ।

সুদানের এক শিশু, যার বয়স মাত্র তিন, তার মায়ের মৃতদেহ টানতে টানতে কাঁদছে—এই দৃশ্য এখন সারা বিশ্বের বিবেক নাড়া দিয়েছে।

সুদান, গাযা, আরাকান—সবখানেই এক প্রশ্ন ধ্বনিত হচ্ছে:

“সভ্যতা কি সত্যিই বেঁচে আছে, নাকি তার মুখোশ পরে মানুষ আজও হিংসার দেবতাকে পূজা করছে?”

সুদানের যুদ্ধ প্রমাণ করেছে—যখন ক্ষমতা ও লোভ একত্রিত হয়, তখন মানবতা সবচেয়ে সহজ শিকার হয়।

একজন মায়ের লাশ টানতে থাকা দুধের শিশু আজ আধুনিক সভ্যতার মুখে থুতু ছুঁড়ে বলছে—

“তোমরা মানুষ নও, তোমরা অস্ত্রের ছদ্মবেশে লুকানো পশু!”

সূত্র:

  • Al Jazeera, “Sudan unrest: What is the Rapid Support Forces?”
  • Britannica, “Rapid Support Forces (RSF)”
  • The Guardian, “Attack on UN aid convoy in Darfur”
  • The Washington Post, “Sudan paramilitary kills dozens”
  • OHCHR, “Appalling reports of summary executions by RSF”