জীবন বড়ই অদ্ভুত!ছেলে ডাক্তার হলো, বাবার হলো দুরারোগ্য ব্যাধি!.

স্বপন মিয়া (বইমজুর) :
ছেলে ডাক্তার হবে। খুশির ইয়ত্তা নেই দিনমজুর বাবার। আগে কাজ করতো এক বেলা। এখন দু’বেলা কাজ করে। সারাদিন কামলা খাটে মানুষের ক্ষেতে। সকালে এক মুঠো ক্ষুদভাত খেয়ে কাজে যায় আসে সেই সন্ধ্যায়। দুপুরে কখনো খায়, কখনো খায় না। তাতে কষ্ট নেই বাবার। সবাই যে বলে, “রহিম মিয়ার ছেলের মাথা ভালা। কেলাসের এক নম্বর।” এতেই মন ভরে যায় বাবার। ছেলে সাইন্সে পড়ে। প্রাইভেট, বই, খাতা, কলম কত্তোকিছু লাগে।

নিজে মন চাইলে কিচ্ছু খায় না। ছেলের যদি কষ্ট হয়। ছেলের পড়াশোনা যদি ক্ষতি হয়। ছেলে যদি রাগ করে পড়া বাদ দিয়ে দেয়। গরু ছাগল হাটবাজার এক হাতে সবই সামলায় বাবা। ছেলেকে একটা খড় ধরতেও বলে না।

এভাবেই ছেলেকে বড় করছে বাবা। মেট্টিকের পর ইন্টারেও গোল্ডেন পায় ছেলে। পুরো এলাকায় বানের জলের মতো ছড়িয়ে পড়ে খুশির খবর। সবাই বাহ! বাহ! দিতে লাগলো রহিম মিয়াকে। এখন টেনশন ছেলে মেডিকেল কোচিং করবে, ঢাকায় যাবে, টাকা লাগবে প্রায় অর্ধলাখ! টাকা পাবে কোথায়? দুধের গরুটা বিক্রি করে ধারদেনা করে ছেলেকে ঢাকা পাঠায় বাবা। ছেলের চিন্তায় খাওয়া নাওয়া বাদ দিয়ে দিয়েছে বাবা। এতো ঋণ কিভাবে দেবে? এতো টাকা খরচ করছে ছেলে ডাক্তার হতে পারবে তো? ছোট ছেলেটা অসুস্থ ডাক্তার দেখানো জরুরি। নিজেও ভোগছে কোমরের ব্যথায় দীর্ঘদিন ধরে। কাউকে বুঝতে দেয় না। তারপর আবার কেউ কেউ বলে,” ফকিন্নির পুতের নাম মিঞা খা”। নিজে খাইতে পায় না, পুলারে ডাক্তর বানাইবো। দেহুম না কি অই। শহরে দিছে, দেখবা কদিন পর মাইয়া লইয়া ভাগবো।” নানান মুখে নানান কথা।

একদিন ছেলের রেজাল্ট এলো ছেলে চান্স পেয়েছে দেশসেরা মেডিকেল কলেজে। বাবা এক টানে মুছে ফেলে কপালের ঘাম। এক জীবনের যতো ক্লান্তি। কিন্তু খরচ তো আরো বাড়বে। কিভাবে টানবে এ খরচের বোঝা?

দমে যাওয়ার পাত্র নয় রহিম মিয়া। প্রয়োজনে নিজেকে পিষে দেবে ঘানি ভাঙা সরিষা তেলের মতো। তবুও ছেলের স্বপ্ন পূরণ করবেই। খাটতে শুরু করে আরো নতুন উদ্যমে। আরো বেগমান গতিতে। শরীরকে শরীর ভাবে না। খাটে রাতদিন।

অবশেষে ছেলে ডাক্তার হলো। বিসিএস ক্যাডার হয়ে যোগদান করলো নিজের উপজেলায়। সবাই স্যালটু দিতে লাগলো রহিম মিয়াকে। পাড়া পড়শী সবাই ভিড় জমায়। নিজেদের ডাক্তার। প্রাণ খুলে বলে মনের যতো কথা৷ ডাক্তারও শুনে। একবারে জায়গায় সাতবার দেখে। ট্রিটমেন্ট করে আপনজনের মতো। তাতে বেজায় খুশি এলাকার লোকজন, আত্মীয়স্বজন। এমন সময় বড্ড খারাপ খবর এলো রহিম মিয়ার। তাকে ধরেছে কঠিন বিমার। যাকে বলে দুরারোধ্য ব্যাধি। যার চিকিৎসা নেই। যাকে বলে মরনরোগ। ছেলে দেখছে ঘন্টার পর ঘন্টা। দেখছে দেশের নামকরা ডাক্তার মহাশয়রা। তাতেও জ্বলেনি আশার প্রদীপ। যার ছেলের কাছে গিয়ে ভালো হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ, তার বাবার চিকিৎসা নেই কোথাও। যে ছেলেকে ডাক্তার বানাতে শরীরের রক্ত পানি করেছে, সেই ছেলেও কাজে আসছে না আজ। যেই ছেলের জন্য নিজের মন চাইলেও একটা চকলেট কিনে খেতো না, সেই ছেলের হাতে এখন লাখ টাকা। যেই ছেলের জন্য জীবন কাটিয়েছে ভাঙা ঘরে, সেই ছেলে তাকে বানিয়ে দিয়েছে বিরাট অট্টালিকা। তাতে শান্তিতে ঘুমুতে পারে না এক দণ্ড। এতো পরিশ্রম, এতো ভালোবাসা, এতো ত্যাগ তিতিক্ষা এখন সবই বৃথা। নিয়তির কি খেলা। ছেলে ডাক্তার হলো, বাবার হলো দুরারোগ্য ব্যাধি!
.
বইমজুর, নকল বাড়ি, গুঞ্জন পাঠাগার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Notice: ob_end_flush(): Failed to send buffer of zlib output compression (0) in /home/pothiknews/public_html/wp-includes/functions.php on line 5309