ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিউজ
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার মেঘনা নদীর কেদেরখোলা বালুমহালের নির্ধারিত সীমানার বাইরে গিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। ইজারার শর্ত অনুযায়ী, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ১০টি খননযন্ত্র দিয়ে বালু তোলার কথা। কিন্তু সে নিয়ম না মেনে দিন-রাত সমানতালে ১৫ থেকে ২০টি খননযন্ত্র দিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, ইজারাদারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতারা জোটবদ্ধ হয়ে এসব কাজ করছেন।
অনিয়ন্ত্রিত বালু উত্তোলনের ফলে নদীতীরবর্তী ফসলি জমির ক্ষতিসহ কয়েকটি গ্রাম হুমকির মুখে পড়েছে। সাবেক এক জনপ্রতিনিধি বালু তোলায় অনিয়মের বিষয়ে এক মাস আগে সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে চিঠি দেন। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ রুহুল আমিন বলেন, বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইনে (২০১০) সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বালু উত্তোলন করার বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। তবে বালুমহালে ঠিক কতটি খননযন্ত্র ব্যবহার করা যাবে, তার কোনো বাধ্যবাধকতা আইনে নেই।
কিন্তু স্থানীয় লোকজনের অভিযোগের ভিত্তিতে পরিবেশের যেন কোনো ক্ষতি না হয়, সে জন্য খননযন্ত্র ব্যবহারের সংখ্যা ১০টি নির্দিষ্ট করে দিয়েছে জেলা প্রশাসন। এসবের বাইরে গিয়ে কিছু করে থাকলে সেটি ইজারাদার অন্যায় করছেন।
বীরগাঁও ইউনিয়ন ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা সালেক আহমেদ গত রোববার বলেন, তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বালুমহালের নির্ধারিত সীমানার ১০০ থেকে ১৫০ ফুট বাইরে ১৩টি খননযন্ত্র দিয়ে বালু উত্তোলন করতে দেখেছেন। নির্ধারিত সীমানায় ফিরে যাওয়ার জন্য ইজারাদারকে বলেছেন। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও জানিয়েছেন।
রোববার দুপুরে সরেজমিনে দেখা গেছে, কেদেরখোলা থেকে ২০০ থেকে ৩০০ ফুট দূরত্বে দাসকান্দি ও শিবপুর মৌজা থেকে খননযন্ত্র দিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। সে সময় ১৫টি খননযন্ত্র এবং ২০ থেকে ২৫টি বড় স্টিলের ইঞ্জিনের নৌকা দেখা গেছে।
দাসকান্দি গ্রামের এক বৃদ্ধ বলেন, ‘দা, বল্লম, ক্রিজ নিয়ে তারা বালু তুলে। তারার কাছে যাওন যা না। অস্ত্রর ডর (ভয়) দেহা। রাতের বেলা পাড়ের কাছে আইয়্যা ড্রেজার দিয়া বালু তুলে। ঘুমাইতে পারি না। অহন সরকার যদি কিছু করে, তাইলে আমরা বাঁচুম।’
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গত ৯ জুলাই কেদেরখোলা বালুমহালটি মো. বরকত উল্লাহর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স জাহানারা কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড সাপ্লাইয়ার্সকে ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
৭ আগস্ট কেদেরখোলা বালুমহালের সঠিক সীমানা নির্ধারণসহ অপরিকল্পিত ও নিয়মবহির্ভূতভাবে বালু উত্তোলন বন্ধের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে চিঠি দেন উপজেলার বীরগাঁও ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য শফিকুল ইসলাম।
অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, কেদেরখোলা বালুমহালের আয়তন ২০ একর। শিবপুর, দাসকান্দি, নজরদৌলত (গাছতলা), ছয়গরহাটি, কেদেরখোলা গ্রামের সামনে দিয়ে ১০০ থেকে ১২০ একর জায়গাজুড়ে ৮০-৯০ ফুট গভীর করে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। প্রতিদিন দিনরাত সমানতালে বালু তোলা হচ্ছে।
২০-২৫টি খননযন্ত্র দিয়ে ১৫ থেকে ২০ লাখ ঘনফুট বালু তোলা হচ্ছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা প্রতি ঘনফুট বালু সাড়ে তিন টাকা হারে বিক্রি করে প্রতিদিন ৪০ থেকে ৪৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। এভাবে বালু উত্তোলন অব্যাহত থাকলে বীরগাঁওয়ের বাইশমোজা বাজারের লঞ্চঘাট থেকে কেদেরখোলা পর্যন্ত বিস্তৃত শিবপুর, দাসকান্দি, নজরদৌলত, ছয়ঘরহাটি হয়ে কেদেরখোলা পর্যন্ত গ্রামগুলোর শত শত একর ফসলি জমি ও কয়েক হাজার মানুষের বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাহমুদা জাহান বলেন, অভিযোগ পেয়ে তাঁরা বালুমহালের সীমানার জায়গা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। নির্ধারিত সংখ্যার বেশি খননযন্ত্র ব্যবহার করায় বালু উত্তোলন বন্ধও রাখা হয়।
বীরগাঁও ইউনিয়নের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান কবির আহমেদ অভিযোগ করে বলেন, বীরগাঁও ইউপি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি হোসেন সরকার, সাবেক সাধারণ সম্পাদক আফজাল হোসেনের নেতৃত্বে বালুমহালের নির্ধারিত জায়গার বাইরে থেকে দিনরাত বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। তাঁদের লোকজন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সারাক্ষণ পাহারাদারের মতো দাঁড়িয়ে থাকেন। তাঁদের কিছু বলা যায় না।
বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত একজন বলেন, ইউপি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন ও হোসেন সরকারের দুটি, আফজাল হোসেনের একটি এবং ইজারাদারের দুটি খননযন্ত্র বালু উত্তোলনে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর বাইরে আরও অনেকের খননযন্ত্র আছে। প্রতিদিন ৬০ থেকে ৭০টি বড় স্টিলের ইঞ্জিনের নৌকায় সাড়ে ৩ লাখ থেকে ৪ লাখ ২০ হাজার ঘনফুট বালু উত্তোলন করা হচ্ছে।
অভিযোগের বিষয়ে বীরগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আফজাল হোসেন বলেন, ‘বরকত উল্লাহ বালুমহালের ইজারা পেয়েছেন। আমার একটি ড্রেজার আছে। আর নির্ধারিত সীমানা থেকেই বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। তবে তহসিলদার এখানে নতুন এসেছেন। তিনি সীমানা চেনেন না।’
বীরগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, তাঁর কোনো খননযন্ত্র নেই এবং এর সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত নন।
একাধিকবার চেষ্টা করে এবং খুদে বার্তা পাঠিয়েও বারবার সংযোগ কেটে দেওয়ায় ইজারাদার বরকত উল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানভীর ফরহাদ বলেন, বালু উত্তোলনের সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে এবং জেলা প্রশাসক খননযন্ত্রের সংখ্যা ১০টি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যদি খননযন্ত্র ১০টির বেশি হয়, তাহলে সেগুলো জব্দ করা হবে। তাঁরা এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন।
সূত্র: প্রথম আলো
পথিক নিউজ/ মো:ইমন