নিলয় নিরুপমাকে আড়াল থেকে দেখে। সামনে আসলে কখনো চোখ তুলে তাঁকায় না। নিরুপমা খুব যে সুন্দরী তা নয়। তবে নিরুপমা নিলয়ের প্রথম ভালোলাগা, প্রথম প্রেম। নিলয় আর নিরুপমার সম্পর্ক টা স্বাভাবিক নয়। আর তাই নিলয় তার ভালোলাগার কথা বলার সাহস পায় না।
নিরুপমা একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষক৷ আর নিলয় গণিত বিভাগের প্রথম বর্ষের একজন মাঝারি মানের ছাত্র। নিরুপমার চাকরি হলো বছর খানেক আগে। বয়স ছাব্বিশ বছর । আর নিলয়ের দু বছর স্টাডি গ্যাপ রয়েছে।সে অনুযায়ী নিলয়ের বয়স ২২ বছর।
নিরুপমা আপাতত একা ই আছে। কিন্তু নিলয় এসব কিছু জানে না। নিলয়ের হৃদয়ে নিরুপমার জন্য এমন এক ভালোবাসা তৈরি হয়েছে যা জাগতিক সব নিয়ম কানুন আর হিসেব নিকাশের বাইরে। তবে, নিলয় কখনো তার সীমা অতিক্রম করেনি। ভদ্রতার হিসেবে সে আর দশটা ছেলের চেয়ে অনেক বেশি মার্জিত।
নিলয় একটা ছোট খাটো ব্যবসা করে, আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী। ভার্সিটিতে প্রতিদিন আসার হয়তো প্রয়োজন নেই নিলয়ের। তাছাড়া, নিলয় ব্যবসার বিষয়ে খুবই সিনসিয়ার। কিন্তু নিরুপমা মেডামের ক্লাস আছে বলেই, তাকে প্রতিদিন আসতে হয়। এ এক অদ্ভুত আকর্ষণ, এক অদ্ভুত শক্তি যার বশবর্তী হয়ে নিলয় তার সমস্ত কাজ, ব্যবসা সব কিছুর উর্ধ্বে শুধু চিন্তা করে কখন নিরুপমা মেডামের ক্লাস শুরু হবে। কখন উনাকে একবার দেখার সুযোগ হবে।
প্রায় ৬ মাস হয়ে গেলো। নিলয় এখনো নিরুপমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। কারণ, ছাত্র হিসেবে নিলয় খুব একটা মেধাবী নয়, আর নিরুপমা মেধাবী শিক্ষার্থীদের বেশি গুরুত্ব দেই।
তবে, নিলয় এককথায় সুদর্শন এক যুবক। নিলয়কে একবার দেখলে নিজের অজান্তেই দ্বিতীয়বার তাঁকাতে হয়। যদিও এই ৬ মাসের মধ্যে নিরুপমা নিলয়কে তেমন ভাবে খেয়াল ই করেনি৷ গণিত বিভাগের প্রথম বর্ষে অনেক ছাত্র ছাত্রী । তাই হয়তো নিরুপমা নিলয়কে খেয়াল করেনি।
একদিন নিলয় অনেক সাহস সঞ্চয় করে নিরুপমার কাছে যায়। নিরুপমা খুবই বন্ধুত্বসুলভ, তবে কোনো প্রকার বেয়াদবি বা অসংলগ্ন আচরণ একদমই সহ্য করে না।
নিলয়ঃ মেডাম, আপনার সাথে একটু কথা ছিলো।
নিরুপমা ঃ হ্যাঁ, বলো।
নিলয়ঃ মেডাম, আমি আপনার কাছে প্রাইভেট পড়তে চাই। আপনার ফোন নাম্বারটা যদি একটু দিতেন,,,
নিরুপমা : তুমি কোন ইয়ারে পড়ো?
নিলয়ঃ মেডাম আমাকে চিনতে পারেন নি? আমি প্রথম বর্ষের ছাত্র নিলয়।
নিরুপমা ঃ ওহ, আচ্ছা। প্রথম বর্ষের একটা ব্যাচ আমি শুরু করেছি। তুমি তমালের সাথে যোগাযোগ করে কর্নফাম করে নিয়ো৷ আমার একটু তাড়া আছে, আসি।
নিলয় খুবই হতাশ হলো, মেডাম এক মিনিটের জন্য তার দিকে একটু তাঁকিয়ে ও কথা বললো না।
পরের দিন নিলয় প্রাইভেটে যায়। পড়াশোনায় এত গভীর মনযোগ দেয় যে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই নিলয় নিরুপমার মনযোগ আকর্ষণ করে নেয়।
প্রাইভেটের ত্রিশজন শিক্ষার্থী মিলে একটি আনন্দ ভ্রমনের পরিকল্পনা করে। নিলয় খুবই আনন্দিত। সে আয়োজক কমিটির সদস্য হতে চাইলো। তখন অন্যান্য শিক্ষার্থীরা বলতে লাগলো, ” আরে নিলয়, তোমার এত পরিবর্তন! তুমি তো কখনো কোনো কাজে থাকতে চাওনা। আর আজ নিজ থেকেই কমিটিতে থাকতে চাচ্ছো। ”
নিলয়ঃ আমি এখন সব কাজেই সিরিয়াস। আর মেডাম যেখানে থাকবে সেখানে তো আন্তরিক ভাবে কাজ করতেই হবে।
তখন গ্রীষ্মকাল। প্রচন্ড উত্তাপ। এরই মাঝে বের হয়ে গেলো নিরুপমা এবং তার ছাত্র-ছাত্রীরা। তারা যে রিসোর্ট নিয়েছে সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে এসেছে।
এরই মধ্যে সবার পানি ও ফুরিয়ে গেলো। সবাই যার পর নাই ক্লান্ত। এদিকে নিরুপমা প্রচন্ড পিপাসার্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু তারা যে জায়গায় এসেছে সেখান থেকে দোকান অনেক দূরে।কেউ সাহস দেখাচ্ছে না যেতে। অথচ নিলয় কখন চলে গেছে, সে কথা কেউ জানতেই পারলো না। কিছুক্ষণের মধ্যে নিলয় পানি নিয়ে হাজির। নিরুপমা তো পুরাই অবাক। তখন ই প্রথম বারের মত নিরুপমা নিলয়কে দেখে।
সৃষ্টিকর্তার কি অপরুপ সৃষ্টি। তার চোখ আর হাসি মুগ্ধ হওয়ার মতো সুন্দর। এ জগতে এমন কিছু সৌন্দর্য আছে, যে সৌন্দর্যের মাঝে অদ্ভুত রহস্য লুকিয়ে থাকে। নিলয় ঠিক এমনই একজন।
তখন থেকে নিরুপমার যে কোনো কাজ করে দিতে নিলয় খুব জেদ করে। কিন্তু নিরুপমা কখনো কাউকে দিয়ে কাজ করাতে পছন্দ করে না। নিজের কাজ নিজেই করতে পছন্দ করে। কিন্তু নিলয় এমন নাছোড়বান্দা, সে নিরুপমার কখন কি প্রয়োজন, সব সময় সেদিকেই নজর রাখে।
একদিন নিরুপমা প্রায় দুই শত খাতা নিয়ে বাসায় যাচ্ছিলো। পথে কোনো যানবাহন পাচ্ছিলো না। ভার্সিটি ও ছুটি হয়েছে অনেক আগে। এমন সময় নিলয় এসে হাজির।
কিন্তু নিলয় কেন বাড়ি যায়নি তা কেউ জানে না। নিলয় মুহূর্তেই নিরুপমার হাত থেকে খাতাগুলো নিয়ে নেয়।
নিলয়ঃ মেডাম, আপনি এত খাতা নিয়ে কিভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি আপনাকে কতো অনুরোধ করে বলেছিলাম, যে কোনো কাজে আমাকে ফোন দেওয়ার জন্য। কিন্তু আপনি হয়তো আমায় সেই যোগ্য ই মনে করেন না।
নিরুপমা : আরে না, না। এমন কিছু না। আমি আসলে নিজের কাজ নিজে করতেই পছন্দ করি।
নিলয়ঃ ঠিক আছে, আপনি না হয় নিজের কাজ নিজে করতে পছন্দ করেন, কিন্তু আপনার কাজ করতে পারলে আমি অনেক বেশি আনন্দ পাই। আমাকে এতটুকু আনন্দ দিলে আপনার তো কোনো ক্ষতি হবে না নিশ্চয়।
নিরুপমা এবার স্পষ্ট বুঝতে পারছে নিলয়ের মনের অবস্থা। কিন্তু সে তখন আর কোনো কথা বলেনি। নিরুপমা হয়তো পরে সুযোগ বুঝে নিলয়ের সাথে এ বিষয়ে কথা বলবে।
নিরুপমার কাছে তখন একটা ফোন আসে।
নিরুপমার খালু ফাহাদ হোসেন অনেক বেশি অসুস্থ। গতকাল রিপোর্ট এসেছে, উনার ক্যান্সার ধরা পড়েছে। নিরুপমা গতকালই বিষয়টা জেনেছে। কিন্তু সে তার খালুর বাসায় যায়নি। যাওয়ার সাহস পায়নি। এই খালুর সাথে নিরুপমার শৈশবের অনেকটা সময় কেটেছে। বড় হয়েও খালুর সাথে খুব বন্ধুত্বসুলভ একটা সম্পর্ক রয়েছে।
খালু ফোন দিয়ে বললো, ” নিরু সবাই আমাকে দেখতে আসলো, আর তুই একটা বার খবর নিলি না। আমার উপর কি কোনো কারণে তোর অভিমান হয়েছে রে?
নিরুপমা কাদঁতে লাগলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, ” খালু আমি এখনি আসতেছি। ”
নিলয় খুব অবাক হয়ে নিরুপমার দিকে তাঁকিয়ে ছিলো। নিলয় বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ভাবছিলো, নিরুপমা মেডাম ও কাঁদিতে পারে! উনার কি এমন দুঃখ থাকতে পারে।
নিলয় ঃ মেডাম কি হয়েছে আপনার? আপনি বাসায় যাবেন না?
নিরুপমা ঃ না আমি বাসায় যাবো না। আমার খালু খুব অসুস্থ। খালুকে দেখতে যাবো। খাতাগুলো আমার কাছে দিয়ে তুমি যেতে পারো।
নিলয়ঃ আরে কি বলেন, মেডাম। রোগী দেখতে যাবেন আপনি এই খাতা হাতে নিয়ে, এ কেমন কথা! আমি কোন দিনের জন্য আছি?
নিরুপমা ঃ বোকার মতো কথা বলো না। আমি যাবো খালার বাসায়, কতো সময় লাগবে জানি না। তোমার এত সময় থাকার দরকার নেই।
নিলয়: প্লিজ মেডাম, আমাকে নিয়ে যান। আপনার মানসিক অবস্থা ভালো না। খাতাগুলো দেখাশোনার দায়িত্বে আমাকে কিছুটা সময় থাকতে দিন।
নিরুপমা খুব অবাক হলো। নিলয়ের চোখে এক অদ্ভুত আকুতি। এই আকুতি ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্য নিরুপমার হলো না।
নিরুপমা ঃ আচ্ছা, ঠিক আছে। সি এন জি ডাকো।
অনেক বছর পর খালার বাড়িতে এলো নিরুপমা। এই কয়েক বছরে কি বিশাল পরিবর্তন সবার। খালু আর খালা অনেক বেশি বৃদ্ধ হয়ে গেছে। হয়তো অসুস্থতা উনাদের এমন বৃদ্ধ করে দিয়েছে।
পুরো বাড়ি জুড়ে কান্নার আবহ। নিরুপমার খালুর বোনেরা এসে এমন কান্না শুরু করে দিলো। মনে হচ্ছে এখন ই বুঝি মারা যাবে নিরুপমার খালু। প্রতিটি মানুষ এসে এই অসুস্থ ফাহাদ আহমেদকে এমন করুনা আর আফসোস দেখাচ্ছে যে এই সব দেখে নিরুপমার খালু ফাহাদ আহমেদের নিজেকে জগতের সবচেয়ে অসহায় মানুষ বলে মনে হচ্ছে।
এদিকে কষ্টে নিরুপমার বুক ফেটে যাচ্ছে। নিরুপমা বুঝে পায় না, মানুষ কেন একটা মানুষকে মৃত্যুর আগেই এতোটা করুণা দেখিয়ে মেরে ফেলে।
নিরুপমা তার খালুর কাছে গেলো। সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে খুব হাসিমুখে খালুকে জিজ্ঞেস করলো, ” কেমন আছো,খালু। কতোদিন পর তোমাকে দেখলাম, আর তুমি রোগীর মতো বিছানায় শুয়ে আছো। চলো আমরা বেড়াতে যাবো। ”
বাড়িতে এত মানুষ৷ সবাই বিস্ময়ে হতবাক। কেউ কেউ ভাবছে, নিরুপমা হয়তো কিছুটা পাগল হয়ে গেছে।
নিরুপমার খালা ঃ নিরু, এইসব কি বলছিস? তোর খালুর কি হয়েছে তুই জানিস না?
নিরুপমা ঃ খালা, তোমরা সবাই কেন এমন অদ্ভুত আচরণ করছো? পৃথিবীতে কেউ জানে না, কে কখন মারা যাবে। আর ক্যান্সার রোগের এখন অনেক ভালো চিকিৎসা রয়েছে৷ আমার কলিগের বাবা ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছে। খালু ও ইনশাআল্লাহ খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে।
এ কথা শুনে নিরুপমার খালুর চোখে মুখে কি যে এক স্বস্তির হাসি। ফাহাদ আহমেদ এখন নিজেকে অনেক বেশি সুস্থ মনে করছেন। মনে হচ্ছে চেপে থাকা নিঃশ্বাসটা আবার প্রাণ ফিরে পেলো৷ আর নিরুপমা ঠিক এমনটাই চেয়েছিলো।
খালাঃ ( আড়ালে) নিরু, ডাক্তার তো তোর খালুকে কয়েক মাসের সময় দিয়েছে।
নিরুপমা ঃ কিন্তু তোমরা তো খালুকে একটা দিনের জন্য বাঁচতে দিচ্ছো না। তোমাদের এমন কান্না আর আর্তনাদে মৃত্যুর ভয় খালুকে দৈনিক এক হাজার বার মেরে ফেলছে।
একটা অসুস্থ মানুষের সামনে কেঁদে তাকে মুমূর্ষু রোগী মনে করিয়ে দেওয়ার মাঝে কি স্বার্থকতা রয়েছে, বলতে পারো?
খালাঃ কথা তো সঠিক। আমাদের কান্নাকাটির জন্য তোর খালুর মনটা অনেক বেশি দূর্বল হয়ে গেছে।
নিরুপমা ঃ এখন থেকে আর কোনো কান্নাকাটি নয়। শুধু আনন্দ আর আনন্দের কথা বলবে। খালুকে এক মিনিটের জন্য অনুভব করতে দিবানা যে উনি অসুস্থ। আর খালুকে দেখতে যারা ই আসবে, সবাইকে এ কথা বলে দিবা।
যে মানুষ টা জীবিত আছে, তার সামনে কেন মরণের কান্না কাঁদতে হবে?
নিলয় সবকিছু ই দেখছিলো, শুনছিলো। নিরুপমা নিলয়কে ডেকে বললো, “একটা সি এন জি নিয়ে আসো । আমরা তিনজন আজ ইচ্ছে মতো ঘুরবে,।”
নিলয় তো আনন্দে একাকার। সে এক দৌড়ে গিয়ে একটা সি এন জি নিয়ে এলো।
এবার তারা সি এন জি দিয়ে চলে গেলো এক গভীর অরণ্যে। নিরুপমার খালু কতো মাস পরে ভালো পোশাক পড়ে, নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে বের হয়েছে।
নিরুপমা সবচেয়ে খুশি হয় তার প্রিয় মানুষগুলোকে আনন্দিত দেখলে। খালুর চোখে মুখে এখন নতুন জীবনের স্বপ্ন। প্রকৃতির মনোরম সৌন্দর্য খালুর মাঝে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করার এক অসীম শক্তি জাগিয়ে দিলো।
কিন্তু সবাইকে যে একসাথে আনন্দিত করা যায় না।
আজ নিলয়ের একটা স্বপ্ন ভাঙ্গবে, চরমভাবেই ভাঙ্গবে। আর এই কাজটা নিরুপমাই খুব যত্নের সাথে করবে।