প্রবাসীদের কষ্ট কেউ বোঝে না, সবাই টাকা খুঁজে।

লেখক:
প্রকাশ: ১১ মাস আগে

স্বপন মিয়া (বইমজুর) : জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে পিতামাতা বন্ধুবান্ধব ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমায় প্রবাসীরা। দূর প্রবাসে কোনো ভাবেই মন বসে না। বাড়ির কথা মনে হলে কাঁদে নীরবে। তবুও এতো টাকা ঋণ করে এসে ভবিষ্যতের কথা ভেবে পড়ে থাকে মাটি কামড়ে। ধীরে ধীরে ঋণ কমে আসে। স্বপ্ন দেখে একটি বাড়ি হবে। হবে ঘর সংসার। এভাবে চলে গেল পাঁচ ছ বছর।

ঘর হলো। সংসার হলো। বাড়লো দায়িত্ব। বাড়িয়ে দিয়েছে কাজের গতি। আট ঘন্টা ডিউটি। পাঁচ ঘন্টা ওভার টাইম। সারা দিন কলুর বলদের মতো খেটে এসে করতে হয় রান্নাবান্না। কখনো কখনো না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ি। মরুভূমির তপ্ত বালুতে কাজ করে ক্লান্ত হয়ে যাই। ভীষণ ক্লান্ত। বাড়ি থেকে ফোন আসে। কপালের ঘামটা এক টানে মুছে ফোনটা ধরি। ধরে একমনে শুনি স্ত্রীর চাহিদা, সন্তানের চাহিদা। একে একে শুনি মা, বাবা, ভাই, বোনদের কার কার কি চাহিদা। চাহিদা যতো বেতন ততো নয়। এটা বুঝতে দিই না। সবাই ভাবে আমি বিদেশি। বিদেশ মানে টাকার গাছ। ঝাক্কি দিলেই পড়ে। বেতন পেয়ে সাথে সাথে টাকা পাঠাই কার কি প্রয়োজন। তবুও ভালো থাকতে পারি না কারো কাছে। স্ত্রীর অভিযোগ মাকে বেশি দিয়েছি। মা’র অভিযোগ স্ত্রীকে সব দিয়ে দিই। ছেলের অভিযোগ অন্য বাবারা বিদেশ থেকে কত্তোকিছু পাঠায়। আমি কিচ্ছু করি না। এতো অভিযোগের ভিড়ে ভুলে যাই জীবনের কাছে থাকা আমার না বলা যতো অভিযোগ।

কেউ একবারের জন্যও জিজ্ঞেস করেনি আমি কি খাই, কি পরি, কোথায় ঘুমাই, আমার বুকের ব্যথাটা কখন ওঠে, ওষুধটা রেগুলার খাই কি না। কেউ জিজ্ঞেস করে না।

মনের দুঃখে মাঝে মাঝে বাড়িতে বলি, “আমি দেশে চলে আসবো।” উত্তর আসে, ” এখন আসা যাবে না। ছেলেমেয়ে বড় হচ্ছে। ওদের একটা লাইন ঘাট করে আসতে হবে।”

বছর তিন চার পর দেশে গেলে দেখি এক বছরের রুজি এক মাসেই শেষ! ছয় মাসের ছুটিতে গিয়ে দেড় দুই মাস পর ফিরে আসি। তখন মনে হয় স্ত্রীর কাছে স্বামীর চেয়ে মাস শেষে টাকার বান্ডিলটা বেশি দরকার। সন্তানের কাছে বাবার চেয়ে ভোগ বিলাসিতা খুব প্রয়োজন।

পঞ্চাশের পর প্রবাস ইস্তফা দিয়ে একেবারে দেশে চলে যাই। কয়েক মাস যাওয়ার পর দেখি পরিবারের সবার বোঝা আমি। কারো কাছেই আমি ভালো না। দিনরাত্রি খেটে নানা অসুখ বাসা বাঁধে শরীরে। শরীরের চেয়ে বেশি পীড়া দেয় মানসিক যন্ত্রণা। সবার সুখের আয়োজন করা লোকটা নিজেই এখন সুখ খুঁজে হন্যে।

এতো কষ্টেট টাকায় বিল্ডিং তুললাম। কোমরের ব্যথায় ঘুম আসে না। রক্ত পানি করা টাকায় বাড়ি করেছি। সবকিছু শ্মশান মনে হয় এখন। ছেলে মেয়ের যেনো বিন্দু পরিমাণ কষ্ট না হয়। কতো ঝড় সয়েছি তাদের জন্য। এখন যে যার মতো করে ব্যস্ত। আমি কাঁদিআএকলা একা। হিসাব মিলাই বেহিসাবি জীবনের। হিসাব মিলে না। কারণ প্রবাসীদের জীবনের কোনো মূল্য নেই!

প্রবাসে আপনি কতোটা কষ্ট করছেন- এ চিন্তাটা আপনার পরিবারের কেউ না করলেও প্রবাসে আপনি কত আয় করছেন এবং সেগুলো কিভাবে খরচ করছেন তার হিসাব সব সময় আত্মীয়-স্বজনরা নিতে ভুল করে না৷ পরিবার-পরিজন ছেড়ে অমানুষিক পরিশ্রম করাটা শারীরিক ও মানসিকভাবেই চরম যন্ত্রণার!

প্রতিটি প্রবাসী পরিবারের জন্য কতোটা ত্যাগ স্বীকার করছে এটা অনুভব করার সময় যেন কারও নেই৷ আয়ের হিসাব নিয়ে সবাই ব্যস্ত৷ প্রতিমাসে প্রতিটি প্রবাসীরই থাকা-খাওয়াসহ আনুষঙ্গিক খরচ রয়েছে৷ এ জন্য আয়ের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ খরচ করতে হয়৷ প্রবাসীরা যতোটা সম্ভব কম খরচ করার চেষ্টা করেন৷ অনেক সময় একই রুমে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবন-যাপন করে খরচ কমায় পরিবারের কথা চিন্তা করে৷ কিন্তু আত্মীয়-স্বজন সেটা বেমালুম ভুলে গিয়ে বেতনের সম্পূর্ণটা মনে মনে দাবি করেন৷

কি এক অদ্ভুত পৃথিবীতে আমরা বাস করি৷ কেউ শুধু ত্যাগ স্বীকার করে আবার কেউ পুরোটাই শুধু ভোগ করার জন্যই প্রস্তুত থাকেন৷ কখনও কখনও প্রাপ্ত অর্থে তারা খুশি হয় না৷ যে যত বেশি আয় করে তার পরিবারের চাহিদার পরিমাণটাও সেই হারে বৃদ্ধি পায়৷ শুধু প্রবাসীরাই বুঝতে পারে অন্য প্রবাসীর মনের কষ্ট। এ ছাড়া প্রবাসীদের কষ্ট কেউ বুঝে না সবাই টাকা খুঁজে।

.

বইমজুর, নকল বাড়ি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।