রাতের অন্ধকারে পৃথিবী হঠাৎ নিঃশ্বাস নিতে ভুলে যায়। সব কিছু থমকে থাকে— ঘড়ির কাঁটা, দেয়ালের ছায়া, এমনকি বাতাসেরও কোনো ইচ্ছা থাকে না জানালার ফাঁক দিয়ে ঢোকার। আমি তখন বসে থাকি নিজের ভেতর— এক অবিকল নীরবতার মধ্যে। অথচ আমার ভিতরে কেউ ধীরে ধীরে পুড়ছে, খুব স্নিগ্ধ ও কোমল ভাবে।
আসলে মানুষ একাকী বাঁচে— কেউ ভালোবাসার ভান করে, কেউ বিশ্বাসের পোশাক পরে, কেউ আবার সব হারিয়ে। কিন্তু রাতের শেষে, যখন শব্দ থেমে যায়, তখন সব মুখোশ খুলে পড়ে যায় বিছানার পাশে। তখন বোঝা যায়— দিনশেষে কেউ কারো নয়, সবাই নিজ নিজ অনন্ত নিঃসঙ্গতার দিকে হাঁটে, আলো-শূন্য এক উপকূলে দিকে। পৃথিবীতে একা হওয়ার চেয়ে বড় অভিশাপ আর কী হতে পারে?
একসময় আমার মনে হতো, ভালোবাসা হলো সুখ পাখি। এখন বুঝি, ভালোবাসা আসলে এক ধরনের আগুন— যা নিভতে জানে না, শুধু ধীরে ধীরে ভিতরটা দগ্ধ করে আর ছাই হয়ে মিশে থাকে বাতাসে , যার গন্ধে সারাজীবন মানুষ আফসোস নিয়ে বেঁচে থাকে।
আমি যাদের ভালোবেসেছি, তারা সবাই একে একে মায়ার জলে ডুবে গেছে। তাদের চোখে একসময় বিশ্বার ও ভরসার আলো দেখেছিলাম, অথচ তা ছিল একটা ভ্রম। আমি তাদের নাম ভুলতে পারিনি, আবার তাদের উপস্থিতিও পাই না—সময়ের ভেতরে তারা আটকে গেছে, আর আমি এখন এক ভাঙা আয়নায় নিজের চেহেরা খুঁজি।
এক রাতে, ঘুম ভেঙে দেখি আমার শরীর নেই— শুধু এক আলোকিত ছাইভস্ম। আমার আত্মা দাঁড়িয়ে আছে নিজের শরীরের পাশে, নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে বুকের আগ্নেয়গিরির দিকে, যা কখনও জ্বলে না, কখনও নিভে না। তখন বুঝলাম— আমি জীবনকে যা ভেবেছিলাম তা নয়, আসলে জীবন এক দীর্ঘ আত্মদহন। যে দহনে মানুষ ধীরে ধীরে নিজেকে পুড়িয়ে ফেলে— ভালোবাসার নামে, স্মৃতির নামে, আর বেঁচে থাকার নামে।
দিনশেষে, কেউ কারো নয়। সবাই নিজের পুড়ে যাওয়া মন নিয়ে হাঁটে প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকারে, এমন এক গন্তব্যের দিকে, যার নাম কেউ জানে না।
লেখক: লিটন হোসাইন জিহাদ, কবি ও সাংবাদিক